শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০১১

বদ্বীপ

শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০১১

বশ মানা শরীরগুলো

আসুন, সপ্তদশ শতকের শুরুতে সৈন্যের যে আদর্শ মূর্তি কল্পনা করা হতো, সেই আদর্শ মূর্তিটির কথা আমরা ফিরে আর একবার ভাবি তো! গোড়ার কথা বলতে হলে, একজন আদর্শ সৈন্য হলেন তিনিই যাকে বহু দূর থেকে দেখেও চমৎকার চেনা যেত। আদর্শ সৈন্যকে চেনার কিছু সহজ লক্ষণ বা চিহ্ন ছিল। একদিকে তাঁর শক্তিমত্তা এবং সাহসের সাধারণ চিহ্ন তো ছিলই, সেই সাথে ছিল তাঁর গৌরবের কিছু লক্ষণ। তাঁর দেহসৌষ্ঠবই তাঁর শৌর্যবীর্য প্রকাশের মাধ্যম। একথা সত্য যে যুদ্ধবিদ্যা একজন সৈনিককে শিখতে হয় অল্প অল্প করে। সাধারণতঃ প্রকৃত যুদ্ধক্ষেত্রেই এই শেখার প্রক্রিয়াটা চলে।  তবু মার্চপাস্ট করার মতো শারীরিক নড়াচড়া কিম্বা গর্বিত ভঙ্গিতে মাথা তুলে রাখার মতো মনোভাব প্রায়শঃই একজন সৈন্যের সামাজিক সম্মানের শারীরিক অলঙ্করণ হয়ে দাঁড়ায়। ‘সৈনিকের পেশার সাথে খাপ খায় এমন বিভিন্ন চিহ্নের ভেতর সজীব কিন্তু সতর্ক ভঙ্গিমা, উঁচু মাথা, টানটান পাকস্থলী, চওড়া কাঁধ, দীর্ঘ বাহু, শক্ত দেহকাঠামো, কৃশকায় উদর, পুরু উরু, পাতলা পা এবং শুকনো পায়ের পাতা উল্লেখযোগ্য। এমন দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী পুরুষটি ক্ষিপ্র এবং বলিষ্ঠ না হয়ে যায় না।’ সৈনিক যখন বর্শাধারী হবেন তখন ‘সৈনিককে মার্চপাস্টের সময় এমনভাবে পা ফেলতে হবে যেন প্রতিটি পদক্ষেপে যথাসম্ভব মহিমা ও ভাবগাম্ভীর্য ফুটে ওঠে। কেননা, বর্শা হলো একটি সম্মানজনক অস্ত্র যা কেবলমাত্র ভাবগাম্ভীর্য ও সাহসের সাথেই শুধু বাহিত হতে পারে।’ (মন্টগোমারি, ৬ এবং ৭)। আঠারো শতকের শেষ নাগাদ ‘সৈন্য’ হয়ে দাঁড়ালো এমন এক ভাবমূর্তি যা এমনকি ছিরিছাঁদহীন এক তাল কাদা থেকেও বানানো যায়। শুরুতে একটি অদক্ষ দেহ। তার দেহভঙ্গিমা ধীরে ধীরে শুধরে নেওয়া হয়। দেহের প্রতিটি অংশে একধরনের হিসেবী সংযম ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়। এই সংযম সৈনিকের দেহটিকে একসময় অধিগত করে; তাকে ইচ্ছামাফিক বদলানোর উপযোগী করে। যেন সৈনিকের দেহটি সবসময়ই হুকুম তামিলের জন্য প্রস্তুত থাকতে পারে। অভ্যাসের স্বয়ংক্রিয়তায় তার শরীর যেন নিঃশব্দে দীক্ষিত হয়। সোজা কথায়, তাকে যেন সহজেই ‘চাষীর ভাব-ভঙ্গি কাটিয়ে উঠে’ ‘সৈনিক সৈনিক ভাব’ দেখতে হয় (১৭৬৪ সালের অধ্যাদেশ ২০)। সৈন্যদের নিয়োগ ক্রমশঃই হয়ে উঠলো ‘তাদের মাথা সিধা ও উঁচু রাখা, পিঠ না বাঁকিয়ে এবং পেটে এতটুকু ভাঁজ না ফেলে টানটান দাঁড়ানো, বুক ও কাঁধ শক্ত করে রাখার মতো ক্ষমতা অর্জনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এমন শক্ত-পোক্ত ভাবে দাঁড়ানোর অভ্যাস অর্জনের জন্য সৈন্যদের দেয়ালে ঠেস দিয়ে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়াতে বলা হতো যেন তাদের পায়ের গোড়ালি, উরু, কোমর এবং কাঁধ দেয়াল স্পর্শ করতে পারে। পিঠ এবং হাতও দেয়াল স্পর্শ করবে। এর ফলে কেউ যদি বাইরের দিকে হাত প্রসারিত করে, শরীর না নেড়েই সে হাত প্রসারিত করতে পারবে… একইভাবে, মাটির দিকে চোখ নিচু করে থাকতে তাদের কখনোই শেখানো হবে না, বরং তাদের পাশ দিয়ে যাতায়াত করা সব মানুষের চোখের দিকে তাদের সরাসরি তাকাতে শেখানো হবে… শেখানো হবে নির্দেশ না আসা অবধি মাথা, হাত ও পা না নাড়িয়ে নিশ্চল থাকতে… এবং শেষপর্যন্ত সাহসী পদক্ষেপে হাঁটু এবং উরু শক্ত রেখে মার্চ পাস্ট করবে তারা। পায়ের পাতার উপর সূচ্যগ্র টানটান ও বাইরের দিকে মুখ করা ভঙ্গিমায় এই মার্চ পাস্ট সম্পন্ন হবে।’ (১৭৬৪ সালের ২০ শে মার্চের অধ্যাদেশ)।
ধ্রুপদী যুগ শরীরকে ক্ষমতার বস্তু এবং লক্ষ্য হিসেবে আবিষ্কার করেছিল। সেসময় শরীরকে ব্যবহারোপযোগী করে তোলা, ছাঁচে ঢালাই করা, প্রশিক্ষিত করার জন্য মনোনিবেশের প্রচুর তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। এত প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য ছিল যেন মানবশরীর অনুগত হয়। যেন সে ক্ষমতার ডাকে সাড়া দেয়, দক্ষ হয় এবং তার শক্তি বৃদ্ধি করে। দুটো নিবন্ধন বা নথিতে মানব-যন্ত্র (Man the Machine) গ্রন্থটি যুগপৎভাবে রচনা করা হয়। এই দুটো নথির প্রথমটি হলো অধিবিদ্যা-অঙ্গব্যবচ্ছেদ নথি (anatomico-metaphysical register) যার প্রথম পাতাটি লিখেছেন দেকার্তে এবং পরবর্তী সময়ে পরমাণুবিদ এবং দার্শনিকেরা এই নথির পরম্পরা রক্ষা করেছেন। অপর নথিটি হলো প্রযুক্তিগত-রাজনৈতিক (technico-political) নথি যা একটি গোটা বিধি-নিয়মের ব্যবস্থা এবং সেনাবাহিনী, স্কুল ও হাসপাতালের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ব্যবহারিক ও নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি দ্বারা গঠিত ছিল। মানব শরীরের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও সংশোধনের জন্যই এই নথিটি গঠিত হয়েছিল। আলোচ্য দুই নথি অবশ্য ছিল পরস্পর সম্পূর্ণ পৃথক। কারণ একটি নথি চেয়েছে মানব শরীরকে নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবহার করতে। অপর নথিটি চেয়েছে শরীরকে সক্রিয় রাখতে এবং ব্যাখ্যা করতে। সুতরাং, এই দুই নথি অনুযায়ী মানব শরীর ছিল দুই ধরনের। প্রয়োজনীয় মানব দেহ ও বুদ্ধিদীপ্ত মানব দেহ। এবং, এমন শ্রেণিকরণের পরও পরস্পর পরস্পরকে অভিক্রমণের প্রবণতা দেখা দিতে পারে। লা মেত্রিসের (La Mettrie’s) মানব যন্ত্র (L’Homme-machine) একইসাথে আত্মার বস্তুগত হ্রাস (materialist reduction of soul) এবং বশ্যতা ভঙ্গের তত্ত্ব বৈকি। এই তত্ত্বের কেন্দ্রে আছে ‘বাধ্যতা’ বা ‘বশ্যতা’র ধারণা যা ‘বিশ্লেষণযোগ্য’ মানব শরীরকে ‘ব্যবহারযোগ্য মানব শরীরে রূপান্তরিত করে। একটি শরীরকে তখনি বাধ্য বা বশ বলা যায় যখন তা অধীনস্থ, ব্যবহৃত, রূপান্তরিত ও উন্নীত হতে পারে। অন্যদিক থেকে দেখলে, মানবশরীরের স্বতোনিয়ন্ত্রণ বা স্বতোশ্চলনের জনপ্রিয় ধারণা মানবসত্তার আন্তঃনির্ভরশীলতা উদাহরণযোগে বর্ণনার পন্থা মাত্র ছিল না। একইসাথে তা ছিল রাজনৈতিক পুতুল নাচ, ক্ষমতার ক্ষুদ্রায়তন নমুনা। সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক, ক্ষুদ্র যত যন্ত্র, সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী এবং দীর্ঘ অনুশীলনের পুঙ্খানুপুঙ্খ সম্রাট, এসব নিয়েই মোহগ্রস্থ ছিলেন।
শরীরকে বশ মানানোর এই প্রকল্পে কি এমন নতুনত্ব ছিল যে গোটা আঠারো শতক এ ব্যাপারে এত আগ্রহী হয়ে পড়লো? শরীরকে এমন কর্তৃত্বব্যঞ্জক এবং কড়াকড়ি বিনিয়োগের অধীনস্থ করার প্রচেষ্টা নিশ্চিতভাবেই এই প্রথম ছিল না। প্রতিটি সমাজেই শরীর ছিল কঠোর ক্ষমতার মুঠোয় যা শরীরের উপর বাধা, নিষেধ ও দায় চাপিয়েছে। যাহোক, কৌশলগুলোতে কিছু নতুন বিষয়ও ছিল। শুরু হতে বললে, শৃঙ্খলায় অন্তর্নিহিত ছিল নিয়ন্ত্রণের কিছু নির্দিষ্ট মাত্রা। কাজেই, এটা অবিভাজ্য এককের মতো শরীরকে ‘গণহারে’ ‘পাইকারি বিক্রয়ের’ বস্তু হিসেবে দেখার মতো কোনো প্রশ্ন ছিল না। শরীরকে ব্যক্তিগতভাবে ‘খুচরা বিক্রি’র মতো কিছু হিসেবে দেখাটাই বরং নির্ধারিত ছিল। শরীরের উপর তীব্র দমনপীড়ন চালানো, নির্মাণকৌশলের স্তরেই শরীরের উপর আধিপত্য ধরে রাখা — নড়াচড়া, দেহভঙ্গিমা, মনোভাব, দ্রুততা: সক্রিয় শরীরের উপর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ক্ষমতা। অতঃপর আসে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যবস্তু। শরীরের ভাষার অথবা ব্যবহারের দ্যোতক উপকরণ হিসেবে এগুলো আর কাজ করছিল না। কিন্তু, শারীরিক গতিশীলতার পরিমিতি ও দক্ষতা, তাদের অভ্যন্তরীণ সংগঠন এবং সংযম প্রতীকের বদলে শক্তির উপরই বেশি স্বাক্ষর রাখে। অনুশীলনই হলো একমাত্র সত্যিকারের উৎসব। আর সবশেষে রয়েছে ক্রিয়াপদ্ধতি: যা মানব শরীরের উপর এক অব্যাহত ও ধারাবাহিক দমনপীড়ন চালায়। যা কিনা ফলাফলের চেয়ে শরীরের কর্মকাণ্ডের প্রক্রিয়া তদারকিতে বেশি ব্যস্ত থাকে। এবং এই অনুশীলন বিধিবদ্ধতার কিছু নিয়মানুসারে পরিচালিত হয় যা যতটা নিবিড়ভাবে সম্ভব সময়, স্থান এবং শরীরের গতিশীলতাকে পৃথক করে। এই পদ্ধতিসমূহ যা কিনা দেহের কার্যক্রমের পুঙ্খানুপুঙ্খ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব করে তুলেছিল, যা কিনা শরীরের শক্তিগুলোর লাগাতার পরাধীনতা নিশ্চিত করেছিল এবং শক্তিগুলোর উপর একধরনের বশ্যতা-উপযোগের সম্বন্ধ আরোপ করেছিল, তাদেরকেই ‘শৃঙ্খলা’ বলা যেতে পারে। সন্ন্যাসীদের মঠ, সেনাবাহিনী ও কারখানায় প্রচুর শৃঙ্খলামূলক পদ্ধতি বহুদিন ধরেই প্রচলিত রয়েছে। তবে, সতেরো ও আঠারো শতক নাগাদ শৃঙ্খলা আধিপত্যের সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। শৃঙ্খলা অবশ্য দাসত্ব থেকে আলাদা। যেহেতু শরীরের আত্মসাৎকরণের সম্বন্ধের উপর তা নির্ভরশীল নয়। তথাপিও মানব শরীরের সাথে তার মূল্যবান এবং ভয়ানক সম্পর্ক প্রয়োগের মাধ্যমে যথাসম্ভব বৃহৎ আকারে উপযোগের ফলাফল অর্জনেই শৃঙ্খলার আভিজাত্য নিহিত ছিল। এই শৃঙ্খলা কিšত্ত ‘সেবা’ থেকেও আলাদা ছিল। ‘সেবা’ ছিল আবার আধিপত্যের এক ধারাবাহিক, সামগ্রিক, প্রকাণ্ড, অ-বিশ্লেষণী এবং অপরিমিত সম্পর্ক যা প্রভুর ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও ‘খামখেয়ালে’র আঙ্গিকে গঠিত ছিল। জায়গিরদারি (vassalage — রাজা বা উপরওয়ালার প্রতি বশ্যতা ও আনুগত্যের শর্তে জমি ভোগকারী প্রজা; জায়গিরদার, অনুগত দাস বা ক্রীতদাস — অনুবাদক) হতেও তা পৃথক ছিল। জায়গিরদারি বা ভূমিদাসত্ব ছিল সমর্পণের চূড়ান্ত মাত্রায় বিধিবদ্ধ কিšত্ত দূরাগত এক সম্বন্ধ যা অধীনস্থের শরীরের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের চাইতে শ্রমের উৎপাদন এবং আনুগত্যের আনুষ্ঠানিক চিহ্নের উপর বেশি জোর দিত। আবার, এই শৃঙ্খলা কিন্তু তপশ্চর্যা বা সন্ন্যাসী সুলভ ‘শৃঙ্খলা’ হতে আলাদা ছিল। কেননা, সন্ন্যাসী সুলভ ‘শৃঙ্খলা’র কাজ ছিল উপযোগ বাড়ানোর বদলে আত্ম-অস্বীকৃতি অর্জন। যদিও সন্ন্যাসী সুলভ ‘শৃঙ্খলা’র ক্ষেত্রেও অপরের মান্যতা অর্জনের বিষয়টি কাজ করতো, তবে এ ধরনের শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তিরই তার নিজের শরীরের উপর ‘প্রভুত্ব’ অর্জনের বিষয়টি বেশি কার্যকর ছিল। শৃঙ্খলার ঐতিহাসিক মুহূর্তটি ছিল ঠিক সেই মুহূর্ত যখন মানব শরীরের শিল্প জন্ম লাভ করেছে। শুধু মাত্র শরীরের দক্ষতা বাড়ানোই কিন্তু শৃঙ্খলার লক্ষ্য ছিল না। কিম্বা, শরীরের বশ্যতা তীব্র করে তোলাটাও এর উদ্দেশ্য ছিল না কিন্তু, একটি সম্পর্কের গঠনে শৃঙ্খলার নির্মাণকৌশল নিজেকেই বেশি অনুগত করে তোলে। যেহেতু তা বিপরীত দিক থেকে অধিকতর উপযোগী হয়ে ওঠে। সেসময় যা গঠিত হচ্ছিল তা হলো দমন-পীড়নের একটি নীতি যা শরীরের উপর কাজ করে। শরীরের উপকরণ, দেহভাষা এবং ব্যবহারের এক হিসাব-নিকাশ করা ব্যবহার। মানব শরীর তখন ক্ষমতার যন্ত্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছিল যা শরীরকে উন্মোচন, ভাঙচুর এবং পুনর্বিন্যস্ত করে। একটি ‘রাজনৈতিক শবব্যবচ্ছেদ’ যা কিনা ‘ক্ষমতার নির্মাণপদ্ধতি’ও বটে, জন্ম নিচ্ছিল এবং এই বিষয়টিই সংজ্ঞায়িত করছিল যে কীভাবে কেউ অন্যের শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করতে পারে আর, অন্যের শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণের এই ব্যাপারটি যেন কারো ইচ্ছামাফিক না হয়। বরং কারো নির্ধারণ করে দেওয়া যাবতীয় কলাকৌশল, গতি ও দক্ষতাসহ শরীর যেন একজনের ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত হতে পারে এভাবেই শৃঙ্খলা অধীনস্থ এবং চর্চিত শরীর তৈরি করে, তৈরি করে ‘বশ মানা শরীর’। শৃঙ্খলা শরীরের শক্তি বাড়ায় (উপযোগের অর্থনৈতিক দিক থেকে) এবং এই একই শক্তিগুলো হ্রাস করে (বাধ্যতার রাজনৈতিক দিক থেকে)। সংক্ষেপে, শৃঙ্খলা ক্ষমতাকে শরীর হতে বিযুক্ত করে। অন্য দিকে, শৃঙ্খলা এক ধরনের ‘প্রবণতা’র বস্তুতে পরিণত হয়। পরিণত হয় ‘দক্ষতা’য়। শৃঙ্খলা দক্ষতাই বাড়াতে চায়। আবার, শৃঙ্খলা শক্তির গতিপথ উল্টে দেয়। বদলে দেয় এই গতিপথ থেকে সম্ভাব্য নির্গত ক্ষমতাকে। এবং এই শক্তিকে কঠোর অধীনস্থতার সম্পর্কেও পরিণত করতে পারে। যদি অর্থনৈতিক বঞ্চনা ক্ষমতা এবং শ্রমের উৎপাদনকে পৃথক করে, তাহলে আমাদের এ কথাই বলতে দিন যে শৃঙ্খলামূলক বলপ্রয়োগ শরীরে বর্ধিত প্রবণতা এবং বর্ধিত আধিপত্যের ভেতর একটি আঁটোসাঁটো সম্পর্ক তৈরি করে।
এই নয়া রাজনৈতিক শবব্যবচ্ছেদের ‘উদ্ভাবনা’কে একটি আকস্মিক আবিষ্কার হিসেবে দেখলে চলবে না। এটা বরং প্রায়শঃ ক্ষুদ্র নানা প্রক্রিয়ার প্রাচুর্য। বিভিন্ন পৃথক উৎস এবং ছড়ানোছিটানো বা ইতস্ততবিক্ষিপ্ত অবস্থানের এই প্রাচুর্য পরস্পর অভিক্রমণ করে, করে পুনরাবৃত্তি। অথবা, একে অপরকে অনুকরণ করে, একে অপরকে সাহায্য করে, প্রায়োগিক এলাকার পার্থক্য অনুসারে একে অপরকে আলাদা করে, সমকেন্দ্রাভিমুখী হয় এবং ধীরে ধীরে একটি স্বাভাবিক পদ্ধতির নীলনক্সা উৎপন্ন করে। ইতিহাসের প্রাথমিক সময়ে শৃঙ্খলার এই নীলনক্সা মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায়তনগুলো থেকে কাজ শুরু করে। পরবর্তী সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্তরেই শৃঙ্খলার কাজ শুরু হয়। ধীরে ধীরে শৃঙ্খলার এই নক্সা হাসপাতালের পরিসরেও কাজ শুরু করে। এবং কয়েক শতাব্দীর ভেতরেই শৃঙ্খলার এই কর্মপদ্ধতিগুলো সেনাবাহিনীর সংগঠনকে পুনর্গঠন করে। কিছু কিছু সময়ে তারা খুব দ্রুতই এক বিন্দু হতে অপর বিন্দুতে সঞ্চালিত হয়েছে (বিশেষতঃ সেনাবাহিনী এবং কারিগরী স্কুল ও মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে কখনো কখনো আবার তারা ধীর লয়ে এবং গোপনভাবে সঞ্চালিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বড় কারখানাগুলোর ক্ষতিকর সামরিকীকরণের কথা বলা যায়। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিছু বিশেষ চাহিদার প্রেক্ষিতে শৃঙ্খলা গৃহীত হয়েছে। একটি শিল্পায়িত উদ্ভাবনা, কিছু মহামারী জাতীয় রোগের পুনরাবির্ভাব ও বিস্তার, রাইফেলের আবিষ্কার বা প্র“শিয়ার বিজয়। উপরোক্ত চাহিদাগুলো অবশ্য শৃঙ্খলার সাধারণ ও বিশেষ রূপান্তরের ক্ষেত্রে কোনো বাধা দেয় নি যা এখন আমরা বর্ণনা করবো।
এখানে অবশ্য যার যার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসহ বিভিন্ন শৃঙ্খলামূলক প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস রচনার কোনো প্রশ্ন আসছে না। আমি শুধু ধারাবাহিক কিছু উদাহরণের কতিপয় জরুরি কলাকৌশলের মানচিত্র প্রণয়ন করতে চাই। যে কৌশলগুলো সবচেয়ে সহজে এক হতে অন্যতে ছড়িয়ে পড়ে। এই কৌশলগুলো সর্বদাই ছিল অনুপুঙ্খ বর্ণনা সহ বিস্তারিত কলাকৌশল। তবে তাদের নিজস্ব গুরুত্বও ছিল। কেননা, এই কৌশলসমূহ শরীরের বিস্তারিত রাজনৈতিক বিনিয়োগের একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিকে সংজ্ঞায়িত করেছে। সংজ্ঞায়িত করেছে ক্ষমতার এক ‘নয়া পরমাণুবিদ্যা’কে। এবং যেহেতু সতেরো শতক হতেই শৃঙ্খলা বিস্তৃততর পরিসর বা এলাকাগুলোতে একনাগাড়ে পৌঁছনোর চেষ্টা করেছে, সেহেতু শৃঙ্খলা সমগ্র সমাজদেহকেই আবৃত করতে প্রয়াস পেয়েছে। চতুর্দিকে প্রসারিত হবার এক বৃহৎ ক্ষমতার সাথে দক্ষতার মিশেল দেওয়া ছোট ছোট কাজ, সূক্ষ্ম নানা ব্যবস্থাপনা (যা আপাতঃভাবে নিষ্পাপ হলেও গভীরভাবে সন্দেহজনক), নির্মাণপদ্ধতিসমূহ যা কিনা অর্থনীতিকে স্বীকার করাটা লজ্জাজনক মনে করেছে অথবা বলপ্রয়োগের তুচ্ছ আঙ্গিকগুলোকে অনুসরণ করেছে — তথাপিও এই শৃঙ্খলাই সমকালীন যুগের আঙিনায় শাস্তি ব্যবস্থার প্রসার ঘটিয়েছে। শৃঙ্খলার বিবরণ দিতে গেলে পুঙ্খানুপুঙ্খ নানা বিষয়ের প্রতি গভীর মনোযোগ দেবার প্রয়োজন হবে। ধারাবাহিক ভাবমূর্তির আড়ালে আমরা যেন শুধু অর্থ না খুঁজে বরং কোনো আগাম সতর্কতাও খুঁজি। সক্রিয়তার অমোচনীয়তাতেই শুধু নয়, আমরা যেন কৌশলের সামঞ্জস্যেও তাদের খুঁজি। ঘুমের ভেতরেও কাজ করে এবং তুচ্ছকেও অর্থ দান করে এমন বৃহত্তর যুক্তির চেয়েও শৃঙ্খলা বস্তুতঃ এক ধরনের দক্ষতাবিশিষ্ট কর্ম। যেন বা এক এক ধরনের মনোযোগী ‘মন্দ উদ্দেশ্য’-এর কাজ যা সবকিছুকেই জবাবদিহিতার মুখোমুখি করে। অনুপুঙ্খতার রাজনৈতিক অঙ্গব্যবচ্ছেদ হলো শৃঙ্খলা।
ধৈর্য্য হারানোর আগেই মার্শাল দ্যু স্যাক্সের (Marshal de Saxe) কথাগুলো স্মরণ করলে আমরা ভাল করবো: ‘যদিও পুঙ্খানুপুঙ্খতা নিয়ে যারা বাড়াবাড়ি করে তাদের মূলতঃ সীমিত বুদ্ধির মানুষ মনে করা হয়, আমার বিবেচনায় পুঙ্খানুপুঙ্খতার এই পর্বটি জরুরি। কারণ, এটিই ভিত্তি। শৃঙ্খলার পুঙ্খানুপুঙ্খতার এই ভিত্তি ব্যতীত কোনো ইমারত গড়া অসম্ভব। কিম্বা, পুঙ্খানুপুঙ্খতার নীতি না বুঝে কোনো কর্মপদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করাও কঠিন। স্থাপত্যের জন্য ভাল লাগা থাকাই যথেষ্ট নয়। একটি ইমারত গড়তে হলে আরো চাই পাথর-কাটা সম্পর্কে জ্ঞান (স্যাক্সে, ৫)। এহেন পাথর-কাটার বিষয়ে গোটা একটি ইতিহাসই রচনা করা যায়। নৈতিক জবাবদিহিতা ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের অনুপুঙ্খ ও উপযোগবাদী যৌক্তিকতার ইতিহাস রচনা করা প্রয়োজন। ধ্রুপদী যুগ এই উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বরং শৃঙ্খলা বাড়িয়েছে। এর মাত্রা বদলে দিয়েছে। শৃঙ্খলাকে প্রদান করেছে তার যথার্থ যন্ত্রোপকরণ। এবং হয়তো নিঃসীম ক্ষুদ্রতার পরিমাপে অথবা প্রাকৃতিক সত্তাসমূহের সবচেয়ে বিস্তারিত চরিত্র চিত্রণে কিছু প্রতিধ্বনি খুঁজে পেয়েছে। বহুদিন ধরেই ‘পুঙ্খানুপুঙ্খতা’ ধর্মতত্ত্ব এবং তপশ্চর্যার একটি প্রণালী হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেকোনো ক্ষেত্রেই, প্রতিটি অনুষঙ্গই দরকারি। যেহেতু ঈশ্বরের দৃষ্টিতে কোনো অসীমতাই একটি ক্ষুদ্র অনুষঙ্গের চেয়ে বড় নয় এবং কোনোকিছুই এত ক্ষুদ্র নয় যা ঈশ্বরের একটি ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা হতে তৈরি হয়নি। পুঙ্খানুপুঙ্খতার প্রতাপের এই প্রবল ঐতিহ্যে, খ্রিষ্টীয় শিক্ষা, যাজকিয় অথবা সামরিক স্কুলশিক্ষার যাবতীয় সূক্ষাতিসূক্ষ বিষয়, যাবতীয় ‘প্রশিক্ষণ’ তাদের জায়গা ঠিকঠাকমতো খুঁজে পেয়েছে। এই শৃঙ্খলাসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য,একজন প্রকৃত বিশ্বাসীর মতোই, কোনো অনুষঙ্গই আর অপ্রয়োজনীয় নয়। তবে, ক্ষমতা গ্রাস করতে চায় সেই নিয়ন্ত্রণ যা শৃঙ্খলার আড়ালে অর্থসহ লুকিয়ে থাকে। চরিত্র-বৈশিষ্ট্য হলো ‘ছোট বিষয় সমূহ’ এবং তাদের শাশ্বত গুরুত্বের প্রতি গাওয়া বৃহৎ স্তোত্রগীতি যা জাঁ বাপ্তিস্ত দো লা সাল (Jean Baptiste de La Salle) গেয়েছেন তাঁর Traite sur les obligations des freres des Ecoles chretiennes (খ্রিষ্টীয় বিদ্যালয়ের ভাইদের দায়দায়িত্ব বিষয়ক চুক্তিনামা)-এ। প্রতিদিনের অতীন্দ্রিয়তা এখানে অনুপুঙ্খতার শৃঙ্খলা দ্বারা সংযুক্ত। ‘ছোট ছোট বিষয়কে অবেহলা করা কী বিপজ্জনক! আমার মতো এক আত্মার জন্য এ ভারি সান্ত্বনাদায়ী অনুধ্যান (consoling reflection)। বড় কর্মদ্যোগের প্রতি সামান্যই উন্মুক্ত। ছোট ছোট বিষয়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার মাধ্যমে অব্যাখ্যেয় প্রগতি (imperceptible progress) অর্জন করা যায়। যা আমাদের সবচেয়ে বেশি পবিত্রতার স্তরে উন্নীত করবে। কারণ, ছোট ছোট বিষয়গুলোই আমাদের বৃহত্তর বিষয়ে টেনে নিয়ে যায়…ছোট ছোট বিষয়; একথা বলা হবে যে, হায় ঈশ্বর, তোমার জন্য বড় কোন্ কাজটিই বা আমরা করতে পারি? আমরা, যত দুর্বল এবং মরণশীল প্রাণী? ছোট ছোট বিষয়; যদি বৃহৎ বিষয়গুলো নিজেদের উপস্থাপন করে, আমরা কি সেই কাজগুলো করব? আমরা কি সেই কাজগুলোকে আমাদের সাধ্যের বাইরে মনে করবো না? ছোট ছোট বিষয়; যদি ঈশ্বর সেগুলোকেই গ্রহণ করেন এবং তাদের বড় বিষয় হিসেবে গ্রহণ করতে চান? ছোট ছোট বিষয়। কেউ একবারও এমনটি অনুভব করেছেন? কেউ কি তার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বিচার করেন? ক্ষুদ্র জিনিস। ধরা যাক, একজন নিশ্চিতভাবেই অপরাধী। কিšত্ত, একজন অপরাধী বলেই তাকে কি আমরা অস্বীকার করতে পারব? ছোট ছোট বিষয়। তবু, অন্তিমে এই ছোট বিষয়গুলো মিলেই কোনো বড় সন্তকে জন্ম দিতে পারে! হ্যাঁ, ছোট ছোট বিষয়। কিšত্ত বৃহৎ উদ্দেশ্য, বৃহৎ অনুভূতি, বৃহৎ অনুগ্রহ, বৃহৎ আবেগ এবং ফলাফল হিসেবে মহৎ মেধা, মহৎ সম্পদ, মহৎ পুরস্কার’ (লা সাল, Traite sur les obligations … ২৩৮-৯)। নিয়মকানুনের পুঙ্খানুপুঙ্খতা, পরিদর্শন ও তত্ত্বাবধানের স্নায়বিক অস্থিরতা, জীবন ও শরীরের ক্ষুদ্রতম ভগ্নাংশের তত্ত্বাবধান দ্রতই যোগাবে এক ধর্মনিরপেক্ষ আধেয়। এই চুক্তিনামা যোগানো হবে স্কুল, ব্যারাক, হাসপাতাল অথবা কারখানার প্রেক্ষিতে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রতা এবং অসীমতার রহস্যময় বীজগণিতের জন্য এক অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত যৌক্তিকতা। এবং এভাবেই আঠারো শতকে দেখা দেয় পুঙ্খানুপুঙ্খতার ইতিহাস যার প্রবক্তা ছিলেন জাঁ-বাপ্তিস্ত দ্যু সাল। দ্বিতীয় ফ্রেডারিকের মাধ্যমে লিবনীজ (Leibniz) এবং ব্যুফোকে (Buffon) ছুঁয়ে ও স্কুলশিক্ষা, চিকিৎসা বিদ্যা, সামরিক কৌশল এবং অর্থনীতির মাধ্যমে এই তত্ত্ব তিনি ব্যাখ্যা করেন। এই তত্ত্বে বলা হয়েছিল যে আঠারো শতাব্দী যেন তার শেষ প্রান্তে আমাদের কাছে নিয়ে আসে সেই মানুষকে যে আর একজন নিউটন হবার স্বপ্ন দেখেন। আকাশ ও গ্রহাণুপুঞ্জের অসীমতার নিউটন নন। বরং ‘ক্ষুদ্র শরীর,’ ক্ষুদ্র গতিশীলতা, ক্ষুদ্র কাজ… এসবের নিউটন। সেই মানুষটিকে দরকার যিনি মঞ্জের (Monge) মন্তব্যের (‘আমাদের আবিষ্কার করবার মতো শুধু একটি পৃথিবীই আছে)’ উত্তরে বলেছেন: ‘আমি কী শুনছি? পুঙ্খানুপুঙ্খতার পৃথিবী ব্যতীত কে আর অন্য কোন্ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছে? সে কোন্ পৃথিবী? এই পুঙ্খানুপুঙ্খতার পৃথিবীতে আমি বিশ্বাস করে এসেছি আমার পনেরো বছর বয়স হতে। আমি তখন এ বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম এবং এই বিষয়টি আজো আমার স্মৃতিতে সক্রিয়। এ এমন এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ যা কখনো পরিত্যাগ করা যাবে না… সেই অন্য পৃথিবীই আজ অবধি আমি যত কিছু আবিষ্কার করেছি বলে গর্ব করি তার ভেতর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যখন আমি এই পৃথিবীর কথা ভাবি, আমার হৃদয়ে বেদনা অনুভব করি’ (সন্ত হিলেইরের নোশনস্ সিন্থেটিকস্ এ হিস্টোরিক দ্যু ফিলোসফি ন্যাচেরেল)-এর মুখবন্ধে এই কথাগুলো উৎসর্গ করা হয়েছে নেপোলিয়ন বোনাপার্টেকে)। নেপোলিয়ন এই পৃথিবী আবিষ্কার করেননি। কিšত্ত, আমরা জানি যে তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খতার এই পৃথিবী সৃষ্টির সাংগঠনিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এবং নিজের চারপাশে ক্ষমতার এক যন্ত্রকৌশল তিনি বিন্যস্ত করতে চেয়েছেন যা তাঁর পরিচালিত রাষ্ট্রে সঙ্ঘটিত ক্ষুদ্রতম ঘটনাও তাঁকে দেখতে সাহায্য করবে। বোনাপার্ট তাঁর আরোপিত কঠোর শৃঙ্খলার মাধ্যমে ‘আলিঙ্গন করতে চেয়েছেন ক্ষমতা কাঠামোর এই গোটা যান্ত্রিক ব্যবস্থাকে যাতে ক্ষুদ্রতম অনুপুঙ্খও তাঁর দৃষ্টি না এড়িয়ে যায়।’ (ত্রেইলহার্ড, ১৪)।
পুঙ্খানুপুঙ্খতার সযত্ন নিরীক্ষণ এবং একইসাথে এই ছোট ছোট বিষয়গুলোর রাজনৈতিক সচেতনতা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবহারের জন্য ধ্রুপদী যুগ হতে উদ্ভূত হয়েছে। উদ্ভবের সেই সময়ে ধ্রুপদী যুগ তার সাথে বহন করেছে বিস্তর কলাকৌশল, পদ্ধতি ও জ্ঞানের এক গোটা সমাহৃতি, বিবরণ, পরিকল্পনা ও উপাত্ত। এবং এই সঙ্কটগুলো হতে সন্দেহ নেই যে আধুনিক মানবতার মানুষ জন্ম লাভ করেছে।
বণ্টনের শিল্প
প্রথম ক্ষেত্রেই, শৃঙ্খলা পরিসর বা স্থানে ব্যক্তির বণ্টন হতে উৎসারিত হয়। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য, এই শিল্প কিছু কলাকৌশল প্রয়োগ করে।
১. শৃঙ্খলার মাঝে মাঝে চারদিকে আবদ্ধ স্থানের (enclosure) প্রয়োজন হয়। আবদ্ধ স্থান হলো এমন একটি বিশেষ এলাকা যা সবার জন্য বিপরীতধর্মী এবং নিজেই নিজের চারপাশে বদ্ধ। এটি হলো শৃঙ্খলাপরায়ণ একঘেঁয়েমি ভরা সুরক্ষিত এলাকা। ভবঘুরে ও ভিখিরিদের বড় ‘বন্দিশালা’ ছিল। ছিল আরো নানা গোপন, অনিষ্টকর ও কার্যকরী যত বন্দিশালা। ছিল বিভিন্ন কলেজ অথবা মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এসব শিক্ষায়তনে ধীরে ধীরে সন্ন্যাসীদের মঠসুলভ মডেল আরোপ করা হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে বোর্ডিং সবচেয়ে নিখুঁত (যদি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত নাও হয়ে থাকে) ব্যবস্থা হিসেবে আবির্ভূত হলো। জেসুইটদের (Ignatius Loyala নাম্নী এক স্পেনীয় যাজক ১৫৩৪ সালে Society of Jesus নামক এই ধর্মসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করেন — অনুবাদক) চলে যাবার পর লুই-লো-ঘ্রঁদে (Louis-le-Grand) বোর্ডিং ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়ালো বাধ্যতামূলক। এই বোর্ডিংকে একটি আদর্শ স্কুলে পরিণত করা হলো (আরিস, ৩০৮-১৩ এবং স্নিডার্স, ৩৫-৪১)। সেখানে ছিল সামরিক ব্যারাক। সিদ্ধান্ত হলো যে সেনাবাহিনী ও ভবঘুরে জনতাকে যার যার জায়গায় রাখতে হবে। লুটপাট ও সন্ত্রাস অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। শহরের ভেতর দিয়ে কুচকাওয়াজ করে চলে যাওয়া সেনাবাহিনীকে যারা ভয় পায় না তেমন স্থানীয় জনতাকে শান্ত করতে হবে। বেসামরিক কর্তৃপক্ষের সাথে সঙ্ঘাত অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে। পলায়ন বন্ধ করতে হবে। ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ১৭১৯ সালের অধ্যাদেশ একসাথে কয়েকশ’ ব্যারাক গঠনের রূপরেখা প্রণয়ন করে। ইতোমধ্যে ফ্রান্সের দক্ষিণে গড়ে ওঠা ব্যারাকগুলোর ছাঁচে এই ব্যারাক স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশ দেওয়া হয় যেন কঠোর বাধানিষেধ এই ব্যারাকগুলোয় মেনে চলা হয়। ‘সমগ্র ব্যারাকটি দশ ফুট উঁচু বহির্প্রাচীর বা বাইরের দেওয়াল দিয়ে আবৃত থাকবে। এই দেওয়াল সব দিক হতে ত্রিশ ফুট দূরত্বে এই ব্যারাকগুলো ঘিরে রাখবে।’ এর ফলে সৈন্যদলে ‘আদেশ ও শৃঙ্খলা বজায় থাকার পরিবেশ বিরাজ করবে যাতে সেনা অফিসারের পক্ষে সাধারণ সৈন্যদের হয়ে প্রতিনিধিত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা সম্ভব হয়।’ (সামরিক অধ্যাদেশ, IXL, ২৫ সেপ্টেম্বর ১৭১৯)। ১৭৪৫ সালে দেশের আনুমানিক ৩২০টি শহরে সেনাবাহিনীর ব্যারাক ছিল। এবং অনুমান করা হয়েছিল যে ১৭৭৫ সালে এই ব্যারাকগুলোর ধারণক্ষমতা ছিল আনুমানিক ২০০,০০০ পুরুষ (ডেইজি, ২০১-৯; ১৭৭৫-এর এক নামহীন স্মৃতিকথা যা Depot de la guerre-(অস্ত্রাগার)-এ উদ্ধৃত, ৩৬৮৯, ১৫৬; নাভের‌্যো, ১৩২-৫)। পাশাপাশি, কারখানাগুলোর বিস্তারের সাথে সাথে পণ্য উৎপাদনের জন্য বড় বড় উৎপাদন এলাকা বিকাশ লাভ করে। এই এলাকাগুলো ছিল একইসাথে সমধর্মী এবং সু-সংজ্ঞায়িত। প্রথমত, সমন্বিত উৎপাদক কারখানাগুলোর আবির্ভাব। অতঃপর আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সদর কারখানাগুলোর (factories proper) আবির্ভাব হয়। এক শোসেদ (Chaussade) লৌহ কারখানাই নিয়েভ্রে (Nievre) এবং লোয়েরের (Loire) ভেতর মেদিন উপদ্বীপের (Medine peninsula) প্রায় পুরো এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। ১৭৭৭ সালে ইন্দ্রেত (Indret) কারখানা স্থাপনের জন্য উইলকিন্সন (Wilkinson) বাঁধ ও পরিখার মাধ্যমে লোয়েরের উপর একটি দ্বীপ নির্মাণ করেন। তৌফে (Toufait) শার্বোন্নিয়েরের উপত্যকায় (valley of the Charbonniere) লো ক্রুসট কারখানা গঠন করেছিলেন। পরে তিনি লো ক্রুসটের আরো রূপান্তর ঘটান এবং কারখানার ভেতরেই শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা করেন। এটা একদিক থেকে যেমন ছিল মাত্রার বদল তেম্নি ছিল এক নতুন ধরনের নিয়ন্ত্রণ। এই কারখানাকে পরিষ্কারভাবেই সন্ন্যাসীদের মঠ, দুর্গ, প্রাচীরঘেরা শহর প্রভৃতির সাথে তুলনা করা হতো। কারখানার অভিভাবক ‘শ্রমিকেরা ফিরে এলেই শুধুমাত্র দরজা খুলবেন। দরজা দ্বিতীয়বার খোলা হবে যখন পরবর্তী দিনের কাজ শুরুর ঘণ্টা আবার পড়বে।’ পনেরো মিনিটের বেশি দেরি হলে কাউকে আর ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হবে না। দিনের শেষে, কারখানার প্রধান ব্যক্তিগণ কারখানার চাবি সুইস প্রহরীর হাতে দিয়ে দেবে। সুইস প্রহরী তখন দরজা খুলবেন (এ্যাম্বোয়েস, ১২, ১৩০১)। উদ্দেশ্য হলো সর্বোচ্চ সুবিধা অর্জন এবং কারখানার সমস্যা যতদূর সম্ভব কমানো। এভাবেই, উৎপাদন শক্তি যতই ঘনীভূত করা হয়, উৎপাদনের উপকরণ ও যন্ত্র সুরক্ষা ও শ্রমিক শক্তির উপর প্রভুত্ব করার জন্য শৃঙ্খলা জোরদার করা হয়। ‘আদেশ এবং পরিদর্শন ব্যবস্থা রক্ষার জন্য সব শ্রমিককে অবশ্যই এক ছাদের নিচে জমায়েত হতে হবে। যেন শ্রমিকদের ভেতর কোনো জাগরণ দেখা দেবার সাথে সাথে তাদের গ্রেপ্তার করার মাধ্যমে কারখানা রক্ষা ও ক্ষয়-ক্ষতি পূরণের দায়িত্বে নিয়োজিত কারখানার পরিচালনা অংশীদার পদক্ষেপ নিতে পারেন।’ (দ্যোফিন, ১৯৯)।
২. কিন্তু, চতুর্দিকে ‘আবদ্ধাবস্থা’র এই নীতি না ধারাবাহিক, না অবিচ্ছেদ্য, না সে শৃঙ্খলামূলক যন্ত্র ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত হিসেবে বিবেচিত। এই যন্ত্রপাতির কাজের পরিসর অনেক বেশি ঢিলাঢালাভাবে এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সম্পন্ন হয়। প্রাথমিক অবস্থান অথবা বিভাজনের নীতির উপর এটি সবচেয়ে বেশি কাজ করে। প্রত্যেক ব্যক্তিরই রয়েছে তার নিজস্ব এলাকা বা পরিসর। এবং, প্রত্যেক এলাকা বা পরিসরের রয়েছে তার নির্দিষ্ট ব্যক্তি। ছোট ছোট দলে মানুষ ভাগ করাটা এড়াও। ভঙ্গ করো সম্মিলিত বিন্যাস। বিশ্লেষণ করো সংশয়ী, বিপুল আকারের এবং ক্ষণস্থায়ী বহুত্ব। শৃঙ্খলামূলক পরিসর ঠিক ততগুলো পরিচ্ছেদেই বিভক্ত হবার প্রয়াস চালায় ঠিক যতগুলো বণ্টনযোগ্য মানব শরীর বা উপকরণ সেখানে বিদ্যমান। কাউকে না কাউকে অবশ্যই অপরিমিত বণ্টনের প্রয়াস বিনাশ করতে হবে। বিনাশ করতে হবে ব্যক্তির অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় হারিয়ে যাওয়ার সংখ্যা, তাদের চতুর্দিকে পরিব্যাপ্ত সঞ্চালন, তাদের বিপজ্জনক সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া যা থেকে কোনো ফায়দা ওঠানো যাবে না। এ ছিল পলায়ন-বিরোধী, ভবঘুরেপনা-বিরোধী এবং সঙ্ঘবদ্ধতা-বিরোধী এক কৌশল। এর মূল লক্ষ্য ছিল শ্রমিকদের উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করা, কোথায় এবং কীভাবে ব্যক্তিকে খুঁজে পেতে বের করতে হবে তা নির্ণয় করা, ব্যবহারোপযোগী যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, অন্যদের বাধা দেওয়া, প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতি মুহূর্তের আচরণ নজরদারি করায় সক্ষম হওয়া এবং এই ব্যবস্থার গুণাগুণ বা ভাল দিকগুলো মূল্যায়ণ, বিচার ও পরিমাপ করা। জানা, প্রভুত্ব করা ও ব্যবহার করার উদ্দেশ্যেই এই প্রক্রিয়া নির্মিত হয়েছিল। শৃঙ্খলা একটি বিশ্লেষণী পরিসর তৈরি করে।
এবং সেখানেও, শৃঙ্খলার এই ব্যবস্থাকে মুখোমুখি হতে হয়েছিল পুরনো যত স্থাপত্যমূলক ও ধর্র্মীয় পদ্ধতির। যেমন, সন্ন্যাসীর কুঠুরি। সন্ন্যাসীর কুঠুরির পৃথক ভাবে ভাগ করা কামরাগুলো যদি বা ছিল বিশুদ্ধগত ভাবেই আদর্শিক বণ্টন, কিন্তু শৃঙ্খলামূলক পরিসর বাস্তবিকভাবেই সর্বদাই হাল্কা বুনন বিশিষ্ট। তপশ্চর্যার নিয়মানুসারেই নৈঃশব্দ্য ছিল শরীর ও আত্মা উভয়ের জন্যই অতি প্রয়োজনীয়। শরীর ও আত্মাকে অবশ্যই, জীবনের কোনো কোনো মুহূর্তে অন্ততঃ, প্রলোভন এবং ঈশ্বরের প্রচণ্ডতার সাথে নিঃসঙ্গভাবে মোকাবেলা করতে হবে। ‘নিদ্রা হলো মৃত্যুর প্রতিচ্ছবি, মঠের আবাসিক আশ্রয় হলো পুণ্যসমাধি (sepulcher)… যদিও মঠের এই আবাসনে সবাই ভাগাভাগি করেই থাকে, তবু প্রতিটি শয্যা এমনভাবে পাতা হয় এবং পর্দা দিয়ে এত চমৎকার ভাবে ঘেরা থাকে যে মেয়েরা এখানে ঘুম থেকে ওঠা এবং ঘুমাতে যাওয়ার সময় কেউ তাদের দেখতে পায় না।’ (মেয়েদের জন্য একটি ভাল আশ্রমের নিয়মকানুন, দেলামেয়ার, ৫০৭)। তবে, এটি আজো একটি ভয়ানক স্থূল পন্থা।
৩.সক্রিয় ক্ষেত্রসমূহের নীতি ধীরে ধীরে শৃঙ্খলামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি পরিসর বিধিবদ্ধ করে ফেলবে যা স্থাপত্য হয়তো কিছু ভিন্নধর্মী ব্যবহারের জন্য ফেলে রেখেছিল। যোগাযোগের জন্য কিছু নির্দিষ্ট স্থান সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল। এই সংজ্ঞায়ন শুধুমাত্র পরিদর্শন বা তত্ত্বাবধানের উদ্দেশ্য থেকে করা হয়নি। বরং এক ব্যক্তির সাথে অপরের বিপজ্জনক যোগাযোগের সম্ভাবনা ভেঙে ফেলবার জন্য এবং একটি ব্যবহারোপযোগী পরিসর তৈরির জন্যও এটি করা হয়েছে। হাসপাতাল বিশেষতঃ সামরিক ও নৌবাহিনীর হাসপাতালগুলোয় এই প্রক্রিয়া পরিষ্কারভাবে দেখা গেছে। ফ্রান্সে রোশেফোর্ট (Rochefort) উভয়তঃ নিরীক্ষা ও নমুনা হিসেবে কাজ করেছে। একটি বন্দর, এবং একটি সামরিক বন্দর যেমন তার নিজস্ব পণ্যের সঞ্চালন, স্বেচ্ছায় বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে আসা মানুষ, যাতায়াতে ব্যস্ত নাবিকদল, অসুখ ও মড়ক — একটি পলায়নের স্থান, চোরাচালান, ছোঁয়াচে রোগ প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বিপজ্জনক নানা মিশ্রণের মোড়, নিষিদ্ধ নানা সঞ্চালনের মিলন-স্থান। বন্দর এলাকায় নৌবাহিনীর হাসপাতালকেই মূলতঃ চিকিৎসা করার কাজ করতে হয়। কিন্তু, চিকিৎসার কাজ করার জন্য এই হাসপাতালকে অবশ্যই পরিশোধক ছাঁকনির (filter) কাজ করতে হবে। বন্দরের ভ্রাম্যমাণ ও ঝাঁকে ঝাঁকে ঘোরাফেরা করা মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য বেআইনী কাজ ও মন্দত্ব বা অশুভ সম্পর্কে সংশয় দূর করতে হবে। রোগ ও ছোঁয়াচে ব্যাধির চিকিৎসাগত তত্ত্বাবধান অন্যান্য নিয়ন্ত্রণের নানা আঙ্গিক হতে অবিভাজ্য। যেমন, সেনাবাহিনী হতে পলাতকদের উপর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ, পণ্যের উপর আর্থিক নিয়ন্ত্রণ, ক্ষতিপূরণ, রেশন, নিখোঁজ হওয়া, আরোগ্য, মৃত্যু বা ছদ্মবেশ ধারণের উপর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের সাথে চিকিৎসাগত নিয়ন্ত্রণও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এ হতেই মূলতঃ কঠোরভাবে পরিসর বণ্টন ও বিভাজনের প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। রোশেফোর্টে গৃহীত প্রাথমিক পদক্ষেপগুলোর ভেতর মানুষের চেয়ে বস্তু কিম্বা রোগীর চেয়ে দামি পণ্যের সুরক্ষার ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর্থিক ও অর্থনৈতিক তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থাপনা চিকিৎসাগত পরিদর্শনের কলাকৌশলের অগ্রগামী হয়েছে। যেমন, তালাচাবির আওতায় ওষুধ রাখা, ওষুধের ব্যবহার লিপিবদ্ধ করা। অল্প কিছুদিনের ভেতরেই রোগীর প্রকৃত সংখ্যা, তাদের অস্তিত্ব, কোন ইউনিটের রোগী ইত্যাদি নিরূপণের জন্য একটি নির্দিষ্ট ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। এরপর শুরু হলো হাসপাতালে রোগীদের আসা-যাওয়ার ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রিত হওয়া। রোগীদের তাদের নিজস্ব ওয়ার্ডে অবস্থান করতে বাধ্য করা হলো। হাসপাতালের প্রতিটি শয্যার পাশে রোগীর নাম ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। হাসপাতালের রেজিস্টার খাতায় প্রত্যেক চিকিৎসাধীন রোগীর নাম নথিবদ্ধ করা হলো। এবং ডাক্তারের পরিদর্শনের সময় এই খাতাটি দেখার নিয়মও চালু হলো। এরপর এলো ছোঁয়াচে রোগের রোগীদের আলাদা রাখা ও তাদের জন্য পৃথক শয্যার ব্যবস্থা। ধীরে ধীরে একটি রোগ নিরাময় এলাকার উপর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক এলাকা বা পরিসর আরোপ করা হলো। হাসপাতাল রোগীদের শরীর, রোগ, রোগের লক্ষণ, জীবন ও মৃত্যু প্রভৃতি ব্যক্তিকীকৃত করার প্রবণতা দেখালো। পাশাপাশি সন্নিহিত অথচ সযতœ প্রয়াসে পৃথকীকৃত একক ব্যক্তিদের তালিকা গঠন করা হলো। শৃঙ্খলা হতে এভাবেই জন্ম নিল চিকিৎসা বিদ্যাগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এক পরিসর। আঠারো শতকের শেষ নাগাদ যে কারখানাগুলো দেখা দিল, সেখানে ব্যক্তিকীকৃত বণ্টনের নীতি (the principle of individual partitioning) আরো জটিল হয়ে দেখা দিল। এটি ছিল একটি নির্দিষ্ট পরিসরে কিছু ব্যক্তিকে জায়গা বিতরণ ও বরাদ্দ করার প্রশ্ন। যে পরিসরে কেউ এই ব্যক্তিদের বিচ্ছিন্ন করে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন। তবে, এই প্রশ্নটি একইসাথে ছিল উৎপাদন যন্ত্রে এই বণ্টনের বিষয়টি পরিষ্কারভাবে সংযোজন করারও প্রশ্ন। উল্লেখ্য, এই উৎপাদন যন্ত্রের ছিল নিজস্ব চাহিদা। শরীরের বণ্টন, উৎপাদন যন্ত্রের পরিসর ভিত্তিক বিন্যাস ও ‘পদাধিকার’ বণ্টনের সক্রিয়তার নানা প্রকার আঙ্গিক পরস্পসংযুক্ত হবার প্রয়োজন ছিল। জোয়ুইয়ে ওবেরক্যাম্পফ কারখানা (The Oberkampf manufactory at Jouy) এই নীতি মেনে চলেছিল। কর্মকাণ্ডের বিস্তৃত প্রকরণ অনুযায়ী এই কারখানা ছিল বেশ কিছু ওয়ার্কশপের সম্মিলনে গঠিত। মুদ্রক, হাতল ঘোরাইকারী, রঙকরিয়ে, নক্সা স্পর্শ করা নারী, খোদাইকারী ও রঞ্জনকারীদের আলাদা আলাদা ওয়ার্কশপ। ১৭৯১ সালে নির্মিত ভবনগুলোর ভেতর বৃহত্তম ভবন নির্মাণ করেছিলেন তৌসেইয়েন্ত বারে (ঞড়ঁংংধরহঃ ইধৎৎব)। এই ভবনটি ছিল ১১০ মিটার লম্বা ও তিন তলা বিশিষ্ট। নিচের তলা মূলতঃ ব্লক ছাপাইয়ের কাজে বরাদ্দ করা হয়েছিল। দু’টি সারিতে মোট ১৩২ টি টেবিল বসানো হয়েছিল। এই ওয়ার্কশপের দৈর্ঘ্য ছিল এতটাই যে মোট অষ্টাশিটি জানালা ছিল। প্রত্যেক ছাপাইকারী টেবিলে তার ‘পুলার’ যন্ত্রটি নিয়ে কাজ করতেন। এই ‘পুলার’ই মূলতঃ রঙ প্র¯ত্তত করতো এবং রঙ ছড়িয়ে দিত। মোট ২৬৪ জন কর্মী ছিল কারখানায়। প্রতিটা টেবিলের শেষে ছিল এক ধরনের র‌্যাক যার উপর সদ্য ছাপাই করা জিনিস শুকাতে দেওয়া হতো (সেইন্ট-মোউর)। কারখানার কেন্দ্রীয় মধ্যবর্তী পথে হাঁটা-চলা করার মাধ্যমে এমন একটি নজরদারি বা পাহারা রাখা সম্ভব হতো যা একইসাথে সাধারণ ও ব্যক্তিগত। শ্রমিকদের উপস্থিতি ও কাজ লক্ষ্য করা, তার কাজের মান লক্ষ্য করা, এক শ্রমিককে অপর শ্রমিকের সাথে তুলনা করা, দক্ষতা ও গতি অনুযায়ী শ্রমিকদের শ্রেণীকরণ করা, উৎপাদন প্রক্রিয়ার ধারাবাহিক স্তরগুলো লক্ষ্য করা ইত্যাদি। এই যাবতীয় ধারাবাহিকতা মিলে একটি কাজ সম্পন্ন করতো। সংশয় দূরীভূত হয়েছিলো। এক কথায় বলতে, প্রাথমিক কার্যক্রম ও স্তরবিন্যাস অনুযায়ী অনুযায়ী উৎপাদন বিভক্ত হয়েছিল এবং শ্রম প্রক্রিয়া সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অন্যদিকে, ব্যক্তি প্রেক্ষিত হতে বিবেচনা করলে, যে শরীরগুলো কাজ করতো, শ্রমশক্তির সেই প্রতিটি চলকের শক্তি, ক্ষিপ্রতা, দক্ষতা, ধারাবাহিকতা প্রভৃতি লক্ষ্য করা হবে এবং সেই অনুযায়ী চারিত্র্যমণ্ডিত, মূল্যায়িত, গণনাকৃত করা হবে। এবং সেই সব ব্যক্তির সাথে এই শরীরগুলো সংযুক্ত করা হবে যারা ছিলেন এর বিশেষ প্রতিনিধি। বৃহদায়তন কারখানার সূচনায়, উৎপাদন প্রক্রিয়ার অন্তরালে, এভাবেই কেউ খুঁজে পাবেন শ্রমশক্তির ব্যক্তিকীকৃত ভগ্নাংশ। শৃঙ্খলামূলক পরিসরের বণ্টন এই উভয় বিষয় নিশ্চিত করতো।

ঈশ্বরণ ----আনিকা শাহ

জুনের এক বিকেলে, যখন মালগুড়ির তাবৎ ছাত্রসমাজের মনে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার রেজাল্ট পাবার উত্তেজনা আলোড়ন তুলছিল, সেই সময়ে ঈশ্বরণ নির্বিকার এবং নির্লিপ্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
ঈশ্বরণ ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসের সবার মধ্যে বয়োজেষ্ঠ্য হবার খ্যাতি অর্জন করেছিল। সে অ্যালবার্ট মিশন স্কুলে এসেছিল ঠোঁটের উপর অস্পষ্ট গোঁফের রেখা নিয়ে, একজন তেজী তরুণ হিসেবে। এখনও অবশ্য তাকে সেখানেই দেখা যাচ্ছিল। শুধু তার গঠন হয়ে উঠেছিল আরও বলিষ্ঠ ও পেশিবহুল এবং চিবুকও তামাটে আর দৃঢ় দেখাচ্ছিল। কেউ কেউ এমনকি এ কথাও বলে যে ঈশ্বরণের মাথায় নাকি সাদা চুল দেখা যায়। প্রথমবার সে যখন ফেল করল তখন তার পরিবারের সবাই তাকে সমবেদনা জানালো। দ্বিতীয়বারও সে তাদের সমবেদনা আদায় করে নিতে সক্ষম হল। কিন্তু ধীরে ধীরে তারাও ছিদ্রান্বেষী আর নাছোড় হয়ে উঠল এবং এক সময় ঈশ্বরণের উপর্যুপরি অকৃতকার্যতায় তার পরীক্ষার উপর থেকে সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। ওর বাবা-মা ওকে প্রায়ই বলতেন, “তুই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কাজের কাজ কিছু করতে পারিস না?” আর ঈশ্বরণও প্রতিবার মিনতি করে বলত, “আমাকে এই শেষবারের মত চেষ্টা করতে দাও।” সে গভীর অনুরাগ নিয়ে নাছোড়বান্দার মত বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার পেছনে লেগে থাকত।
আর এখন পুরো শহর উত্তেজিত রেজাল্টের প্রতীক্ষায়। ছেলেরা দল বেঁধে রাস্তায় ঘুরতে লাগল; সরযুর তীরে ঝাঁক বেঁধে বসে ঘাবড়ে-যাওয়া হাসি হাসতে হাসতে নখ কাঁমড়াতে লাগল। অন্যরা সিনেট হাউসের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্নভাবে সেটার দেয়ালের দিকে–যার পেছনে কোনো মিটিং চলছিল–তাকিয়ে থাকল।
ছেলেদের চেয়ে বেশি না হলেও, বাবা-মায়েদের উত্তেজনা ছিল ছেলেদের মতই। অবশ্য ঈশ্বরণের বাবা- মা ছাড়া। তারা প্রতিবেশীদের মুখে তাদের ছেলের ভবিষ্যৎ ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মন্তব্য করলেন, “ঈশ্বরণের জন্য তো আর চিন্তা করার কিছু নাই। ওর ফলাফল তো বিখ্যাত আর সবারই আগাম জানা আছে।” ঈশ্বরণও ইয়ার্কি করে বলল, “আমি হয়ত এবার পাশ করেছি, বাবা। কে জানে! এইবার তো আমি বেশ ভালভাবেই পড়েছিলাম।” “এই মুহূর্তে গোটা ইন্ডিয়ার সবচেয়ে আশাবাদী মানুষটা তুই ই। এই একগুঁয়ে আশাটা না থাকলে নিশ্চয়ই তুই ফি বছর একই পরীক্ষা দিতি না।” “আমি তো গত বছর কেবল লজিকে ফেল করেছি, তাও অল্পের জন্য”, সে নিজের সাফাই গাইল। একথায় তার পুরো পরিবার হেসে উঠল। “যাই হোক, তুই বাইরে গিয়ে অন্য ছেলেদের সাথে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছিস না কেন?” ওর মা জিজ্ঞেস করলেন। “কোনো দরকার নাই” ঈশ্বরণ বলল, “আমি যদি পাশ করি তাহলে সেই খবর ওরা ঘরেই নিয়ে আসবে। তোমার কি মনে হয়, আমি গত বছর আমার রেজাল্ট দেখেছিলাম? আমি সময় কাটাচ্ছিলাম একটা সিনেমায় বসে। পর পর দুইটা শো দেখেছিলাম আমি।”
বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হবার আগে সে গুন গুন করতে করতে হাত-মুখ ধোয়ার জন্য ভেতরে গেল। সে খুব যত্ন নিয়ে চুল আঁচড়াতে লাগল, কারণ সে জানত যে বারবার ফেল করার জন্য সবাই তাকে অনেকটা ব্রাত্য হিসেবেই গণ্য করে। সে জানত যে তার পিঠপিছে তার পুরো পরিবার এবং পুরো শহর তাকে উপহাস করছিল। তার মনে হল যেন সবাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল যে এই হাত-মুখ ধোয়া, চুল আঁচড়ানো কিংবা ইস্ত্রি করা জামা গায়ে দেয়া–এগুলো তার অবস্থার তুলনায় একটু বেশিই বিলাসবহুল। সে ব্যর্থ এবং এই বিলাসিতা উপভোগের কোনো অধিকার তার নেই। তার সাথে সবাই এমনভাবে ব্যবহার করত যেন সে কোনো মোটা চামড়ার গাধা। সে কখনও এসব পাত্তা দিত না। বরং তাদের ব্যবহারের জবাবে এমনভাবে আচরণ করত যেন সেও একজন খুব হিংস্র দুর্বৃত্ত। কিন্তু এসব ছিল কেবলই মুখোশ। এর পেছনে ছিল এমন এক প্রাণী যে ব্যর্থতার ঘায়ে পুরোপুরি বিপর্যস্ত ছিল। যেদিন রেজাল্ট দেবার কথা, সেদিন ভেতরে ভেতরে সে উৎকণ্ঠায় কাঁপছিল। “মা”, সে বলল, “আজকে রাতে আমি বাসায় খাব না। আমি কোনো একটা হোটেলে কিছু খেয়ে নিব আর প্যালেস টকিস-এর দুটো শোই দেখব।”
বিনায়ক স্ট্রিট থেকে বের হবার পর সে দেখল একদল ছেলে মার্কেট স্ট্রিট ধরে কেেলজের দিকে যাচ্ছে। কেউ একজন জিজ্ঞেস করল: “ঈশ্বরণ, রেজাল্ট দেখতে যাচ্ছ নাকি?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাচ্ছি। কিন্তু তার আগে আমাকে জরুরি একটা কাজে যেতে হবে।”
“কোথায়?”
“প্যালেস টকিস।” এ কথায় সবকটা ছেলে সমস্বরে হেসে উঠল। “মনে তো হচ্ছে তুমি এর মধ্যেই তোমার রেজাল্ট জেনে গেছ।”
“হ্যাঁ। না জানলে তোমাদের কী মনে হয় আমি ছবির সাথে এটা উদযাপন করতাম?”
“তোমার নম্বর কী?”
“সাত-আট-পাঁচ”, সে বলল; মাথায় প্রথম আসা সংখ্যার রাশিটাই বলে দিল সে।
দলের ছেলেরা বলতে থাকল, ঠাট্টা করে, “এবার তো তুমি ফার্স্ট ক্লাসই পাবে, আমরা জানি।”
ঈশ্বরণ চার-আনা ক্লাসের পেছনের দিকের কোণার একটা সিটে বসল। সে চারিদিকে তাকাল: পুরো থিয়েটারে আর একটা ছাত্রও নেই। শহরের সব ছাত্ররা ছিল সিনেট হাউসের পাশে, রেজাল্টের জন্যে অপেক্ষারত। পুরো থিয়েটারে একমাত্র ছাত্র হওয়ায় ঈশ্বরণের খুব খারাপ লাগল। নিজের প্রতি রীতিমত বিতৃষ্ণা হতে লাগল তার।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাতি বন্ধ হয়ে গেল আর শো শুরু হল। চেনা সব দেবতাদের নিয়ে একটি তামিল ছবি। শীঘ্রই সে নিজেকে দেব-দেবীদের রাজনীতি আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝে হারিয়ে ফেলল। এক স্বর্গীয় জগতের দৃশ্য, যা কোনো পরিচালক দেখানোর জন্য বেছে নিয়েছিলেন, দেখে সে মোহাবিষ্ট হয়ে বসে রইল। অবশ্য এই বিস্মৃতির আনন্দ মাত্র আধঘণ্টা স্থায়ী হল। এর পরই ছবির নায়িকা স্বর্গের একটা গাছের নিচু এক ডালে উঠে বসলেন এবং সেই জায়গা থেকে আর সরার নামই নিলেন না। তিনি আধ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সেখানে বসে গান গাইতে লাগলেন। এই অংশটা ঈশ্বরণকে ক্লান্ত করে দিল। আর তখনই ফিরে এল তার পুরানো সব বেদনা ও হতাশা । “ওহ্, ভদ্রমহিলা,” ঈশ্বরণ আবেদন করল, “আমার দুঃখ-দুর্দশা আর না বাড়িয়ে দয়া করে সরে যান।” ঈশ্বরণের অনুরোধ শুনেই যেন বা তিনি সরে গেলেন আর উজ্জ্বলতর ঘটনা তার অনুগামী হল। যুদ্ধ, মহাপ্লাবন, মেঘের দেশ থেকে একজন হঠকারীকে ফেলে দেওয়া, কারও সমুদ্র থেকে উঠে আসা, আগুনের বৃষ্টি, পুষ্পবৃষ্টি, মানুষের মৃত্যু, মানুষের কবর থেকে উঠে আসা–এমন অনেক কিছুই ঘটল। তামাকের ধোঁয়ার আচ্ছাদনের পেছনে থাকা সাদা পর্দায় এমন অনেক রোমাঞ্চকর দৃশ্যের অবতারণা হল। পর্দায় থেকে থেকে দেখানো লাগাতার বকবকানি, সঙ্গীত আর চিৎকার, সোডা বিক্রয়রত ফেরিওয়ালাদের হাঁক, দর্শকদের অসংযত মন্তব্য–এইসব হইচই আর উত্তেজনা কয়েক ঘণ্টার জন্য ঈশ্বরণকে সিনেট হাউস আর তার ছাত্রজীবনকে ভুলে থাকতে সাহায্য করল।
শো শেষ হল রাত দশটায়। রাতের শো-এর অপেক্ষায় অনেকেই গেটের সামনে ভিড় করে ছিল। ঈশ্বরণ প্যালেস টকিস-এর উল্টোদিকের একটা রেস্টুরেন্ট ’আনন্দ ভবন’-এর দিকে হাঁটতে লাগল। দোকানের মালিক বোম্বের অমায়িক ভদ্রলোকটি, যিনি কিনা ঈশ্বরণের বন্ধুও ছিলেন, হাঁক দিলেন, “ঈশ্বর সাহেব, রেজাল্ট তো আজকে জানানো হল। তোমারটার খবর কী?”
“এ বছর আমি কোনো পরীক্ষা দেইনি,” ঈশ্বরণ বলল।
“কেন, কেন, আমি তো জানতাম তুমি পরীক্ষার ফি দিয়েছিলে!”
ঈশ্বরণ হাসল, “তুমি ঠিকই জানো। আমি এই বিকেলেই ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছি।”
“বাহ্, খুব ভালো। তুমি না জানি কত বুদ্ধিমান! তুমি যদি হনুমানজির কাছে প্রার্থনা কর তাহলে তিনি সবসময় তোমাকে সাফল্য এনে দিবেন। এরপর তুমি কী করবে?”
“আমি আরও উঁচু ক্লাসে উঠব, এই আর কি,” ঈশ্বরণ বলল। সে দু-চার ধরনের মুখরোচক খাবার আর কফির অর্ডার দিয়ে যাবার জন্য উঠল। সে যখন বিল দিয়ে বের হতে যাচ্ছিল তখন হোটেলের মালিক বলে উঠলেন, “তোমার এই সাফল্য উপলক্ষে যদি কোনো অনুষ্ঠান কর তাহলে আমাকে আবার বাদ রেখ না কিন্তু।”
ঈশ্বরণ আবার একটা টিকেট কিনল আর ছবি দেখতে গেল। আরেকবার তার সামনে দেবতাদের শত্র“তা, বিবাদ আর ষড়যন্ত্রের পুনরাবৃত্তি ঘটল। সে আবার সেসবের মাঝে ডুবে গেল। যখন সে পর্দায় দেখল তার বয়েসী কিছু ছেলে দূরের কোনো স্বর্গের জলে গান গাইতে গাইতে খেলছে, সে বলল, “তোমরা তো এমন করতেই পারো। তোমরা যেখানে আছ সেখানে নিশ্চয়ই কোনো পরীক্ষা নেই…” আর সেই জগতের অংশ হবার আকাক্সক্ষা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।
এরপর নায়িকা আবার গাছের ডালে বসে গান গাইতে শুরু করলেন আর ঈশ্বরণও ছবির উপর থেকে সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। প্রথমবারের মত সে চারিদিক দেখল। আধো-অন্ধকারেও সে লক্ষ্য করল, ছেলেদের বেশ কয়েকটা দল হলে আছে–আনন্দিত দল। সে জানত, ওরা সবাই নিশ্চয়ই নিজেদের রেজাল্ট দেখেছে আর এখন এসেছে নিজেদের সাফল্য উদযাপন করতে। সেখানে অন্তত পঞ্চাশজন ছেলে ছিল। সে জানত, ওরা সবই নিঃসন্দেহে খুব সুখি আর আনন্দিত, ঠোঁট লাল করে রেখেছে পান চিবিয়ে। সে জানত, আলো জ্বলে উঠবার সাথে সাথেই সে হবে ওদের সবার মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু। ওরা সবই ওকে ওর রেজাল্ট নিয়ে জ্বালাতন করা শুরু করবে–আবার শুরু হবে সেই পুরানো একঘেয়ে ঠাট্টা আর ওর বেপরোয়া হবার ক্লান্তিকর অভিনয়। পুরো ব্যাপারটার উপরই সে বিরক্ত হয়ে উঠল। এই সফল মানুষগুলোর হাসিখুশি চেহারা আর তাদের কটাক্ষ–এসবের কিছুই আর সহ্য করার শক্তি নেই তার। সে নিশ্চিত ছিল যে তারা সবাই তার দিকে এমনভাবে তাকাবে যে এই দিনে ওর ছবির মাঝে আনন্দ খুঁজে বেড়ানোর কোনও কারণ নেই।
ঈশ্বরণ হলের আরও বেশি অন্ধকার একটা কোণের দিকে সরে আসল। সে পর্দার দিকে তাকাল–তাকে আনন্দ দেবার মত কিছুই সেখানে নেই: নায়িকা এখনও বসে আছে আর সে জানত যে নিঃসন্দেহে আগামী বিশ মিনিট ধরে সে সেখানেই বসে তার ‘মাস্টারপিস’টি গাইতে থাকবে… ঈশ্বরণ হতাশ হয়ে গেল। সে উঠে দাঁড়ালো, নিঃশব্দে একধার দিয়ে দরজার দিকে যেতে লাগল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসল। সেই কৃতকার্য ছেলেগুলোকে দেখে তার নিজের প্রতিই ঘৃণা জন্মালো। “আমি বাঁচার উপযুক্ত না। যে একটা পরীক্ষাও পাশ করতে পারে না…” হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি এল–তার সকল সমস্যার চমৎকার সমাধান–মারা যাওয়া এবং এমন এক জগতে যাওয়া যেখানের ছেলেরা পরীক্ষা থেকে মুক্ত, যারা স্বর্গোদ্যানের পদ্মপুকুরে খেলে বেড়ায়। কোনো ঝামেলা নাই, বছরের পর বছর নিরাশা নিয়ে তাকিয়ে থাকার জন্য কোনো জঘন্য সিনেট হাউস নেই। এই সমাধান হঠাৎ তাকে কেমন এক মুক্তির অনুভূতি এনে দিল। তার নিজেকে খুব হালকা লাগছিল। সে হোটেলের দিকে হাঁটতে শুরু করল। হোটেলের লোকটি তখন সব বন্ধ করে ঘুমাতে যাচ্ছিল। “শেঠজি”, ঈশ্বরণ বলল, “এই সময়ে আপনাকে জ্বালাতন করার জন্য মাফ করে দেন। আমাকে একটু কাগজ আর একটা পেন্সিল দিতে পারবেন? আমার জরুরি একটা জিনিস লিখতে হবে।” “এত রাতে…” লোকটি বলতে বলতে ওকে এক টুকরো কাগজ আর একটা ক্ষয়ে যাওয়া পেন্সিল এনে দিল। ঈশ্বরণ ওর বাবার জন্য একটা বার্তা লিখে খুব সতর্কভাবে কাগজটা ভাঁজ করে নিজের কোটের পকেটে রেখে দিল।
পেন্সিলটা ফেরত দিয়ে সে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলো। সে মাত্র রেসকোর্স রোডের নাগাল পেল, তারপর ডানে গেলেই আছে আঁকাবাঁকা মার্কেট রোড, তারপর আছে এলামেন স্ট্রিট আর তারপর সরযু। সরযু… যার কালো পাঁক-খাওয়া জল ওর সমস্ত দুঃখের অবসান ঘটাবে। “আমাকে এই চিঠিটা কোটের পকেটে রাখতে হবে আর মনে করে কোটটা নদীর তীরে রেখে যেতে হবে”, সে নিজেকে বলল।
সে শীঘ্রই এলামেন স্ট্রিট পার হয়ে আসল। তার পা নদীতীরের বালি চষে বেড়াতে লাগল। নদীর পাশে ধাপগুলোর কাছে এসে সে চটপট তার কোটটা খুলে নেমে যেতে লাগল। “ঈশ্বর”, হাতজোড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বিড়বিড় করতে লাগল, “দশ বারের চেষ্টায়ও যদি আমি একটা পরীক্ষা পাশ না করতে পারি, তাহলে আমার এই পৃথিবীর অপমান বাড়িয়ে বেঁচে থাকার দরকার কী?” ওর পা তখন পানিতে ডোবানো ছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে সে ইউনিভার্সিটির দালানগুলোর দিকে তাকাল। সিনেট হাউসের বারান্দায় তখনো আলো জ্বলছিল। প্রায় মাঝরাত হয়ে আসছে–এখান থেকে সেখানে হেঁটে যেতে মিনিট পনের লাগবে। এখন যেয়ে শেষবারের মত নোটিশবোর্ডটা দেখে আসলে কেমন হয়? সে তো মারাই যাচ্ছে। সে কেন বোর্ডটা এড়িয়ে যাবে আর কেনই বা সেটার সামনে যেতে ভয়ে কাঁপবে?
সে পানি থেকে বেরিয়ে ধাপ বেয়ে উঠতে লাগল। কোটটা পেছনে ফেলে রেখেই সে বালুর মধ্য দিয়ে হাঁটতে লাগল। মাথার উপর তারা জ্বলছিল। কোথাও ঘড়িতে বারোটা বাজার শব্দ, নদীর জলের অস্পষ্ট ঝির ঝির শব্দ আর তীরের ঝোপগুলো থেকে রাতে শুনতে পাওয়া যায় এমন নানান শব্দ ভেসে আসছিল। ঈশ্বরণের ভেজা, ধুলো-ঢাকা পা ছুঁয়ে বাতাস বয়ে গেল। দোদুল্যমান মন নিয়ে সে সিনেট হাউসের বারান্দায় এসে ঢুকল। “আমার এখানে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই”, সে অস্পষ্টস্বরে বলল। সিনেট হাউস তখন ছিল একেবারেই জনশূন্য, একটা শব্দও শোনা যাচ্ছিল না। পুরো দালানটাই ছিল অন্ধকার, কেবল নিচের সিঁড়িকোঠা ছাড়া–সেখানে বড় একটা বাতি জ্বলছিল। আর দেয়ালে ঝুলছিল নোটিশবোর্ড।
ওর বুক ধড়ফড় করছিল যখন ও পা টিপে টিপে রেজাল্ট দেখতে এগুচ্ছিল। বাল্বের আলোয় সে সতর্কভাবে নাম্বারগুলো দেখতে লাগল। ওর গলা শুকিয়ে আসছিল। থার্ডক্লাসে যারা পাশ করেছে সে তাদের রোল নাম্বারগুলো দেখল। ওর নাম্বার ছিল ৫০১। তার আগের নাম্বারগুলোর মধ্য থেকে পাশ করা একজনের নাম্বার ৪৯৮, আর পরেরগুলো থেকে ৭০৩। “তাহলে আমার দুপাশের বন্ধুরাই এখানে আছে”, অনেকটা জোর করেই সে গলায় উচ্ছ্বাস নিয়ে এলো। সিনেট হাউসে আসবার সময় তার মনে এই আশা উঁকি দিচ্ছিল যে হয়ত তার নাম্বারটা কৃতকার্য পরীক্ষার্থীদের সারিতে থাকবে। সে অনুমান করেছিল এরপর তার অনুভূতি কী হত… সে তক্ষুনি ছুটে বাড়ি যেত আর সবাইকে বলত তাদের টিটকারিগুলো ফিরিয়ে নিয়ে ক্ষমা চাইতে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ যাবত নোটিশবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকবার পর তার উপর অকৃতকার্যতার কঠোর ছায়া নেমে আসল: তার নাম্বার কোথাও ছিল না। “সরযু…”, সে বলল। তার নিজেকে এমন এক নিরুপায় আসামীর মত মনে হচ্ছিল যাকে অপ্রত্যাশিতভাবে মুক্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কিন্তু ভুল করে। “সরযু”, ঈশ্বরণ বলল, “আমি যাচ্ছি সরযুতে” সে যেন নোটিশবোর্ডটাকেই এ কথা বলে কয়েক ধাপ পিছিয়ে গেল। “কয়জন অনার্স পেল তা তো দেখা হল না।” সে আবার নোটিশবোর্ড দেখতে গেল। সে উপরের দিকের কলামগুলোতে চোখ বুলাল। আশ্চর্যজনকভাবে এক নাম্বার রোলওয়ালা এক ছেলে ফার্স্টক্লাস পেয়েছে, সঙ্গে আরও ছয়জন। “কীভাবে যে এরা ফার্স্টক্লাস পেল কে জানে”, ঈশ্বরণ প্রশংসার সুরে বলে। ওর চোখ সেকেন্ড ক্লাসের দিকে গেল– ৯৮ দিয়ে শুরু করে দুই লাইনেই নাম্বারগুলো লেখা। প্রায় পনেরজনের নাম্বার ছিল। পরের নাম্বারটিতে যাবার আগে সে প্রতিটা নাম্বার মনযোগ দিয়ে দেখছিল। সে ৩৫০-এ এসে থামল। তারপর ৪০০, তারপর ৫০১ আর তারপর ৬০০।
“পাঁচ-শূন্য-এক সেকেন্ড ক্লাসে! এটাও কি সত্যি হতে পারে?” সে চিৎকার করে উঠল। সে বারবার নাম্বারটা দেখতে লাগল। হ্যাঁ, নাম্বারটা সেখানেই ছিল। ঈশ্বরণ সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে। “এটা যদি সত্যি হয় তাহলে সামনের মাসে আমি বি,এ ক্লাসে থাকব!” সে চেঁচিয়ে উঠল। নীরব দালানগুলোর মাঝে তার কণ্ঠ প্রতিধ্বনি তুলল। “ছাল ছাড়িয়ে ফেলব তার এরপর থেকে যে আমাকে বোকা বলবে”, সে ঘোষণা করল। ওর মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল। এত বছরের খাটুনি আর উৎকণ্ঠা হঠাৎ শিথিল হয়ে গেল। এই শৈথিল্যের চাপ সহ্য করতে ওর কষ্টই হচ্ছিল। ওর শিরা-উপশিরা দিয়ে রক্ত দ্রুতবেগে ছুটে এসে মাথায় যেন ধাক্কা দিয়ে যেতে লাগল। ও অনেকটা জোর করেই নিজেকে শান্ত করল। তারপর গুন গুন করে আপনমনেই একটা সুর ভাঁজতে লাগল। ওর মনে হচ্ছিল যে ও পৃথিবীর একমাত্র বাসিন্দা, এবং এর একচ্ছত্র অধিপতি। ও বুক চাপড়ে নোটিশবোর্ডকে উদ্দেশ্য করে বলল, “জানো, আমি কে?” কোনো এক কাল্পনিক গোঁফে তা দিতে দিতে ও আপনমনে হেসে বলল, “ঘোড়া কি তৈরি হয়েছে, সহিস?”, সে নোটিশবোর্ডটার দিকে এমন এক বাঁকা চাহনি দিল যেন সেটা খুব তুচ্ছ আর তারপর রাজার মত গটগটিয়ে হেঁটে চলে গেল। বারান্দার শেষ সিঁড়িটাতে দাঁড়িয়ে সে তার ঘোড়াটাকে খুঁজতে লাগল। সে মিনিটখানিক অপেক্ষা করেই কাউকে যেন হুকুম করল, “ঘোড়াটাকে কাছে আন, নির্বোধ। কথা কানে যায় না?” ঘোড়াটাকে কাছে আনা হল। সে এমন ভঙ্গি করল যেন সে ঘোড়ায় চড়ছে। তারপর সে রাগের চোটে ঘোড়ার পিঠে চাবুক মারল। তার কণ্ঠ অন্ধকার নদীতীর জুড়ে প্রতিধ্বনি তুলল–সে শব্দ ঘোড়াকেও ছুটতে প্ররোচিত করল। সে হাত দুটো ছড়িয়ে তীর ধরে ছুটতে লাগল, যতটুকু সম্ভব নিজের গলা চড়িয়ে বলল, “সবাই সরে যাও, রাজা আসছেন। যে এই পথে আসবে তাকে পিষে ফেলা হবে…।”
“আমার পাঁচশ’ একটা ঘোড়া আছে”, সে যেন রাতকে উদ্দেশ্য করেই বলল। নাম্বারটা তার মনে গেঁথে ছিল আর বারবার উঠে আসতে লাগল। সে পুরো তীর ধরেই দৌড়ে বেড়াতে লাগল, বারবার। কিন্তু তাতেও তাকে সন্তুষ্ট মনে হল না। “প্রধানমন্ত্রী”, সে বলল, “এই ঘোড়াটা ভাল না। আমাকে আরও যে পাঁচশ’ একটা ঘোড়া আছে সেগুলো এনে দাও–সবগুলো সেকেন্ড ক্লাসে আছে।” সে যে ঘোড়াটায় চড়ছিল সেটাকে একটা লাথি দিয়ে নেমে পড়ল। প্রধানমন্ত্রী শীঘ্রই তাকে আরেকটা ঘোড়া এনে দিল। সে গাম্ভীর্য নিয়ে কাল্পনিক সেই ঘোড়াটায় উঠে বসল আর বলল “এই ঘোড়াটা আরও ভাল।” তারপর সে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বেড়াতে লাগল। দৃশ্যটা ছিল খুবই অদ্ভুত। তারার ক্ষীণ আলোতে, এত রাতে একলা সে মুখ দিয়ে ঘোড়ার খুরের ট্যাপ-ট্যাপ শব্দ অনুকরণ করে যাচ্ছিল। এক হাত লাগাম টেনে ধরার মত ঝুলিয়ে রেখে অন্য হাত দিয়ে সে তার গোঁফে তা দিচ্ছিল। সে ঘোড়াটাকে ততক্ষণ পর্যন্ত তাগাদা দিচ্ছিল যতক্ষণ না সেটা ঝড়ের বেগে ছুটতে শুরু করে। বাতাসের মাঝ দিয়ে ছুটে চলার সময় তার নিজেকে মনে হচ্ছিল দিগি¦জয়ী বীর। কিছুক্ষণের মধ্যে সে পুরো বালুরাশি পার হয়ে আসল। জলের একদম কিনারে এসে সে কিছুক্ষণ ইতস্তত করল, তারপর তার ঘোড়াকে বলল, “তুমি কি পানি ভয় পাও নাকি? তোমাকে সাঁতরে পার হতেই হবে। নাহলে কক্ষণও আমি তোমার জন্য পাঁচশ’ এক রুপি খরচ করব না।” তখন তার মনে হল ঘোড়াটা যেন একটা লাফ দিল।
পরদিন দুপুরে নদীতীর থেকে সিকিমাইল দূরে ঈশ্বরণের দেহ ভেসে উঠল। ইতোমধ্যেই কয়েকজন মিলে তীরে ফেলে যাওয়া ওর কোটটা তুলে নিয়েছিল আর সেটার ভেতরের পকেটে এক টুকরো কাগজ আবিষ্কার করেছিল যাতে লেখা ছিল–
“প্রিয় বাবা, তুমি যখন এই চিঠিটা পাবে ততক্ষণে আমি সরযুর তলায় থাকব। আমি বাঁচতে চাই না। আমাকে নিয়ে ভেবো না। তোমার তো আরও ছেলে আছে যারা আমার মত গর্দভ না…।”

ডেনিস ডাটনের বক্তৃতা

আজ আমার প্রিয় একটা বিষয় নিয়ে কথা বলবো। নন্দনতত্ত্ব আমার পেশা। দার্শনিক, বৌদ্ধিক ও মনস্তাত্ত্বিক আঙ্গিক থেকে আমি সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতাকে বুঝতে চেষ্টা করি। এ বিষয়ে যুক্তিগতভাবে কী বলা যায়? বিষয়টা জটিল। তার একটা কারণ হলো এর পরিধি, ভেবে দেখেন, কত বিচিত্র কিছুকে আমরা সুন্দর বলি—একটা শিশুর মুখ, বার্লিওজের ‘হ্যারল্ড এন ইতালি’, উইজার্ড অফ ওজ-এর মতো সিনেমা, চেখভের নাটক, ক্যালিফোর্নিয়ার প্রাকৃতিক দৃশ্য, হকুসাইয়ের আঁকা ‘মাউন্ট ফুজি’, ওর্য়াল্ড কাপ ফুটবলে একটা দারুণ গোল, ভ্যান গগের ‘স্টারি নাইট’, জেন অস্টেনের উপন্যাস অথবা পর্দায় ফ্রেড এস্টেয়ারের নাচ। এই সংক্ষিপ্ত তালিকায় আছে মানুষ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, শিল্প ও অন্যান্য মানবিক দক্ষতা। তালিকাভুক্ত সমস্ত কিছুর সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করা সহজ কাজ হবে না।
তবে আমি, আমার জানা মতে আজ সৌন্দর্য বিষয়ক সবচেয়ে শক্তিশালী থিওরির সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিতে পারি। এবং এ থিওরি কোন দার্শনিক বা পোস্টমডার্ন শিল্পের নামকরা কোন সমালোচকের কাছ থেকে আসেনি, এসেছে এক জাহাজীর কাছ থেকে, যিনি কেঁচো আর কবুতর পালতেন। এতক্ষণে নিশ্চয়ই আপনারা বুঝে গেছেন যে আমি চার্লস ডারউইনের কথা বলছি।
‘সৌন্দর্য’ কী? অনেকেই মনে করেন তাঁরা এই প্রশ্নের উত্তর জানেন। যেমন, ‘সৌন্দর্য থাকে যে দেখে তার দৃষ্টিতে’ অথবা ‘যা কিছুই আমাদের ব্যক্তিগতভাবে নাড়া দেয়, তাই সুন্দর।’ অথবা কেউ কেউ, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীরা বলে থাকেন ‘সৌন্দর্য থাকে যে দেখে তার সংস্কৃতি-নিয়ন্ত্রিত দৃষ্টিতে।’ কোনো চিত্রকর্ম, ছায়াছবি বা সঙ্গীত আমাদের সুন্দর লাগে কারণ সাংস্কৃতিক সমরূপতা নির্ধারণ করে আমাদের রুচি; এই বিষয়ে একমত সবাই। প্রাকৃতিক ও শৈল্পিক সৌন্দর্যের রুচিবোধ আসলে কিন্তু এক দেশ থেকে আরেক দেশে সহজেই ঘোরাফেরা করে। জাপানের মানুষ বিটোভেন ভালোবাসে, পেরুতে জাপানের ব্লক প্রিন্টের কদর আছে, বৃটিশ যাদুঘরে যত্নে রাখা আছে ইনকা ভাস্কর্য আর শেক্সপিয়ার তো অনূদিত হয়েছেন পৃথিবীর প্রায় সব ভাষায়। অথবা মার্কিন জ্যাজ বা ছায়াছবির কথা ভাবেন, সর্বত্রই যাতায়াত তাদের।
বিভিন্ন শিল্পে পার্থক্য অনেক কিন্তু আবার এমন কিছু তাৎপর্য ও ভালো লাগা আছে যা সংস্কৃতিকে অতিক্রম করে যায়। এই সমরূপতা কীভাবে আমরা ব্যাখ্যা করবো? সবচেয়ে ভালো উত্তর পাওয়া যাবে যদি আমরা শিল্প ও সৌন্দর্যের বিকাশ বিষয়ে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের পুনঃনির্মাণ করি। তা করতে গেলে প্রথম থেকে শুরু করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতে হবে—কী করে প্রাগৈতিহাসিক পরিবেশ আর আমাদের বিকাশকালের বিভিন্ন পরিস্থিতিই ঠিক করে দিয়েছে বর্তমান শৈল্পিক রুচি বা পছন্দ। এ ক্ষেত্রে আমরা প্রাগৈতিহাসিক সময়ের সংরক্ষিত ফসিল, গুহাচিত্র ইত্যাদি বিভিন্ন তথ্যের সাহায্য নিতে পারি। আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি যে ১৯ অথবা ২০ শতকের বিচ্ছিন্ন হান্টার (শিকারী) ও গ্যাদারার (সংগ্রাহক) সমাজ সেই প্রাচীন সৌন্দর্যবোধ কতটুকু ধরে রেখেছিল।
সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা, তার অনুভূতির তীব্রতা ও আনন্দসহ, যে আমাদের বিকশিত মননের অংশ—এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। এই অভিজ্ঞতা ডারউইনীয় অভিযোজনের একটা সিরিজের অংশ। সৌন্দর্য একটা অভিযোজিত পরিণতি যা আমরা প্রসারিত বা তীব্র করি সৃষ্টি, কাজ, শিল্প ও বিনোদনের মাধ্যমে। অনেকেই জানেন বিবর্তনের দুইটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে।
প্রথম অংশ হলো ‘ন্যাচারাল সিলেকশান’ বা ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’। প্রাকৃতিক কারণেই প্রাচীনকাল থেকে নানা ভাবে রূপান্তরিত হতে হতে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছি আমরা। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমেই আমাদের চুল, চোখ কিংবা হাতের নখ বিবর্তিত হয়েছে। আমাদের বিভিন্ন বিতৃষ্ণা বা ভীতি, যেমন পচে যাওয়া মাংসের দুর্গন্ধ, সাপের ভয় কিংবা কোনো খাঁড়াইয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ভয়—সবই প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় । বিভিন্ন আনন্দ বা পরিতৃপ্তি যেমন মিষ্টি, চর্বি ও প্রোটিনযুক্ত খাবারের প্রতি আকর্ষণ অথবা যৌনতাও ব্যাখ্যা করে প্রাকৃতিক নির্বাচন।
বিবর্তনের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ‘সেক্সুয়াল সিলেকশান’, এর কার্যক্রম আবার একদম অন্যরকম। এর সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হলো ময়ূরের পেখম। এর বিকাশ প্রাকৃতিকভাবে টিকে থাকার জন্য ঘটে নাই, বরং প্রাকৃতিক নিয়মের উল্টোদিকেই যায় এই পেখম। এটা এসেছে ময়ূরীদের সঙ্গী নির্বাচনের ফলাফলস্বরূপ। আর কে না জানে যে মেয়েরাই ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে চলে! এ প্রসঙ্গে বলে রাখি যে, ময়ূরের পেখম যে ময়ূরীর চোখে সুন্দর ছিল এই বিষয়ে ডারউইন নিঃসন্দেহ ছিলেন।
এখন এই বিষয়গুলি মনে রেখে বলতে পারি যে, সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা এসেছে আমাদের আকর্ষণ, মুগ্ধতা বা আচ্ছন্নতা জাগিয়ে তোলা এবং ধরে রাখার জন্য বিবর্তনের একটা উপায় হিসাবে, যাতে আমরা টিকে থাকা ও প্রযোজনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারি। বলা যায়, সৌন্দর্য হলো দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রাকৃতিক উপায়। আমরা নিশ্চয়ই আমাদের শিশু, প্রেমিক অথবা কোন একটা সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য খেয়ে ফেলি না! বিবর্তনের কৌশল হলো আমাদের চোখে তাদের এরকম আকর্ষণীয় করে তোলা, যাতে তাকিয়ে থাকতেই ভালো লাগে।
আসুন কিছুক্ষণের জন্য নান্দনিক আনন্দের একটা গুরুত্বপূর্ণ উৎসের কথা ভাবি—সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের আকর্ষণী ক্ষমতা। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষেরা একটি বিশেষ ধরনের প্রাকৃতিক দৃশ্য পছন্দ করে। যা দেখতে সেই বিবর্তনকালের সাভানার মতন। সেই একই দৃশ্য এখনও আমরা দেখি ক্যালেন্ডারের পাতায়, পোস্টকার্ডে, গলফ খেলার মাঠের নকশায়, ফ্রেমে বাঁধানো ছবিতে যা নিউইয়র্ক থেকে নিউজিল্যান্ডের বসার ঘরে শোভা পায়। এই দৃশ্যে থাকে খোলা প্রান্তর, ঘাসের জমি আর মাঝে মাঝে গাছের সারি। গাছগুলির আবার প্রায়ই নিচের দিকে ডালপালা থাকে, তার মানে, বিপদ আপদে গাছে উঠতে চাইলে পারা যাবে এরকম। এইসব দৃশ্যে পানি থাকে কাছেপিঠেই অথবা অন্তত খানিকটা দূরে নীল রঙ দিয়ে পানির অস্তিত্ব দেখানো হয়। পশু ও পাখির অস্তিত্বের প্রমাণ থাকে আর থাকে নদীতীরে, সমুদ্রতীরে বা গাছের সারির ভেতর আঁকাবাঁকা পথ যা দিগন্তের দিকে চলে গিয়েছে, যেন আপনাকে সেই পথ ধরে চলার আহ্বান করছে। এমনকি যে সব দেশে এরকম প্রাকৃতিক দৃশ্য নেই, সেই দেশের মানুষের কাছেও এটা সুন্দর। পৃথিবীর সর্বত্রই যে মানুষ একই ধরনের ভিশ্যুয়াল অভিজ্ঞতায় সৌন্দর্য খুজেঁ পায়, তার খুব ভালো একটা উদাহরণ হলো এই আদর্শ সাভানা দৃশ্য।
 কিন্তু এ তো গেল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। শৈল্পিক সৌন্দর্য কি পুরোপুরিভাবেই সাংস্কৃতিক নয়? না, আমি তা মনে করি না। আবার আমি প্রাগৈতিহাসিক সময়ের দিকে ফিরে এর ব্যাখ্যা দিতে চাই। অনেকেই অনুমান করেন যে ল্যাসকু (Lascaux) এবং শাওভে (Chauvet)-এর অসম্ভবরকম দক্ষ গুহাচিত্রগুলিই মানুষের সৃষ্টি করা প্রথম আর্ট। শাওভের গুহাগুলি প্রায় বত্রিশ হাজার বছর পুরানো, কেভ পেইন্টিং ছাড়াও একই সময়ের তৈরি কিছু নারীমূর্তি ও পশুপাখির আকৃতি পাওয়া গেছে গুহাগুলিতে। তবে শৈল্পিক অলঙ্করণের চর্চা কিন্তু এই সময়েরও অনেক আগের। ঝিনুক বা শামুকের মালা যা এখন আমরা প্রায়ই আর্ট ও ক্রাফট-এর মেলাগুলিতে দেখি এবং বডি পেইন্টের নিদর্শন পাওয়া গেছে প্রায় এক লক্ষ বছরেরও আগে থেকে। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত প্রাচীন শিল্পকর্ম । আসলে সেই সময়েরও অনেক আগেকার। আমি একুলিয়ান হ্যান্ড অ্যাক্স (acheulian hand axe) এর কথা বলছি। মানুষের তৈরি সবচেয়ে আদিম পাথরের হাতিয়ার হলো কাটারি, যা পাওয়া গিয়েছিল আফ্রিকার ওল্ডুভাই গর্জ (Olduvai Gorge)-এ, প্রায় আড়াই মিলিওন বছর আগে। এই কাটারিগুলি ছিল বেশ স্থুল ধরনেরর হাতিয়ার।
প্রায় দেড় মিলিয়ন বছর আগে হোমো ইরেক্টাসরা শুরু করেছিল পাতলা পাথরের ব্লেড বানানো। কখনো ডিম্বাকৃতির কিন্তু কখনো আবার এরা ছিল আকষর্ণীয় ত্রিভুজাকৃতির পাতার মতোন দেখতে বা ‘টিয়ার ড্রপে’র আকারের। পৃথিবীর যেখানেই (এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকা) হোমো ইরেক্টাস আর হোমো ইরগাস্টারদের যাতায়াত ছিল, সেখানেই পাওয়া গেছে হাজার হাজার একুলিয়ান হ্যান্ড এ্যাক্স।
শুধু শিকার করার জন্য এত বেশী সংখ্যক অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল না। রহস্য আরো ঘনীভুত হয় যখন বোঝা যায় যে অন্যান্য প্রাগৈতিহাসিক অস্ত্রের মতোন এই হ্যান্ড এ্যাক্সগুলিতে তেমন ক্ষয়ের চিহ্ন নেই, আর এর মধ্যে কিছু ছিল বড় আকৃতির এবং ব্যবহার অনুপযোগী। এদের সামঞ্জস্য, গঠন প্রণালী ও খুঁটিনাটি এখনো আমাদের চোখে সুন্দর।
এই প্রাচীন হাতিয়ারগুলি তবে কিসের নিদর্শন? উত্তর হলো এরাই সবচেয়ে পুরানো শিল্প। ব্যবহারিক অস্ত্রের এই বিমুগ্ধকর নান্দনিক রূপান্তর প্রাগৈতিহাসিক মানুষের কারিগরী দক্ষতা প্রতীয়মান করে। ডারউইনীয় ইতিহাসে ‘হ্যান্ড এ্যাক্স’ সভ্যতার নতুন এক ধাপের চিহৃস্বরূপ। এই হাতিয়ার তৈরিই হয়েছে ডারউইনীয়দের ভাষায় ‘ফিটনেস সিগন্যাল’ এর জন্য। অর্থাৎ এও ময়ূরের পেখমের মতোনই এক বস্তু, পার্থক্য শুধু এই যে—প্রকৃতি নয়, এর স্রষ্টা মানুষ। হ্যান্ড এ্যাক্স-এর একজন দক্ষ কারিগর ছিল কাঙ্খিত পুরুষ। এই দক্ষতা প্রমাণ করতো যে নির্মাতার রয়েছে বুদ্ধি, কর্মনিপুণতা, সচেতনতা ও দূরদর্শিতা।
হাজার হাজার প্রজন্ম ধরে এ ধরণের দক্ষতাসম্পন্ন মানুষ সামাজিক অবস্থান, চাহিদা ও পুনর্জননের ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থেকেছে। আপনারা তো সবাই জানেন, সেই প্রথম পরিচয় বাক্য যা আজও সমান উপযোগী-‘এসো আমার গুহায় এসো, তোমাকে আমার বানানো হ্যান্ড এ্যাক্স দেখাই!’ অবশ্য মজার ব্যাপার হলো—আমরা জানি না, এই ভাবের আদান প্রদানের ধরণ ঠিক কী রকম ছিল তখন। কারণ হোমো ইরেক্টাসদের তখনো কোন ভাষা ছিল না। বিস্ময়কর হলেও সত্যি এটা। ভাষা ব্যবহার শুরু হওয়ার পঞ্চাশ থেকে এক’শ হাজার বছর আগেই এই হাতিয়ার বানাতো হোমো ইরেক্টাস আর হোমো এনগাস্টাররা।
এক মিলিয়ন বছরেরও পুরানো এই হ্যান্ড এ্র্যাক্স মানব ইতিহাসে শিল্পের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী সৃষ্টি। এই হ্যান্ড অ্যাক্স-এর মহাকাব্যের পর হোমো সেপিয়েন্সরা নিঃসন্দেহে নতুন নতুন উপায়ে একে অপরকে মুগ্ধ করেছে। যেমন: হাসি তামাশা, গল্প বলা, নাচ কিংবা চুল বাঁধা।
আধুনিক মানুষের ক্ষেত্রে গল্পে বা সিনেমায় তৈরি হয় কল্পনার জগৎ। আমরা অনুভূতির তীব্রতা প্রকাশ করি সঙ্গীত, চিত্রকলা অথবা নাচে। তবু আমাদের সৌন্দর্য চেতনায় এখনো সেই প্রাচীন পূর্বপুরুষের ছায়া রয়ে গেছে। যে কোন দক্ষতার প্রদর্শনীতে সৌন্দর্য খুঁজে পাই আমরা। ল্যাসকু থেকে লুভর বা কার্নেগি হল সর্বত্রই আমাদের সহজাত রুচিতে এর প্রমাণ রয়েছে।
দক্ষতার সাথে সম্পন্ন যে কোনো কাজ আমাদের চোখে সুন্দর হয়ে ওঠে। কোন গয়নার দোকানে টিয়ার ড্রপ আকারের কোনো পাথর দেখলে মনে করার কারণ নেই যে আমাদের সংস্কৃতিই শিখিয়েছে তাকে সুন্দর বলতে। বরং আমাদের সুদুর পূর্বপুরুষও ভালোবাসতো এই আকৃতি, আর কদর করতো এর নির্মাণের পেছনের দক্ষতাকে। সেই সময় থেকে, যখন ভালোবাসা প্রকাশের ভাষাও ছিল না তাদের কাছে।
সত্যি কি সৌন্দর্য নির্ভর করে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির উপর? না। বরং এই বোধ আমাদের মস্তিষ্কের অংশ, যা আমরা উপহারস্বরূপ পেয়েছি প্রাচীন পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। কোন সুন্দর প্রতিকৃতি, আবেগ-এর প্রকাশ, শিল্প বা সংঙ্গীতের সৌন্দর্য অথবা রাতের আকাশ দেখে মুগ্ধতা বহন করবে আমাদের উত্তরপুরুষরাও, যতদিন পর্যন্ত মানুষের অস্তিত্ব থাকবে।

ডেনিস ডাটন সম্পর্কে



ডেনিস ডাটনের জন্ম ৯ ফেব্রুয়ারী ১৯৪৪, ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ফারনান্দো ভ্যালি তে, সেখানে তাঁর বাবা-মা একটা বইয়ের দোকানের মালিক ছিলেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন সানটা বারবারায়, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়াতে, ১৯৭৫ সালে এখান থেকেই ফিলোজফিতে পি.এইচ.ডি করেন। এখানে শিক্ষকতাও করেছেন কিছুদিন। ১৯৭৬ সালে মিসিগান ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতার সময় তিনি ‘ফিলজফি এ্যান্ড লিটারেচার’ নামে ষান্মাসিক সাময়িকী বের করা শুরু করেন। এই সাময়িকী ১৯৮৩ সালে তাঁর কাছ থেকে কিনে নিয়েছিল জন-হপকিন্স ইউনিভার্সিটি, তবে তিনি সম্পাদক হিসাবে থেকে গিয়েছিলেন।
পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য নিউজিল্যান্ড চলে আসেন এবং ১৯৮৪ সাল থেকে ক্রাইস্টচার্চের ক্যান্টারবেরী ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা আরম্ভ করেন।
তিনি ‘নিউজিল্যান্ড স্কেপটিক’দের স্থাপয়িতা ছিলেন এবং প্রথম চেয়ারম্যান। এই দল নিউজিল্যান্ডের বেশ কয়েকজন শিক্ষক, বৈজ্ঞানিক, যাদুকর, ডাক্তার এবং অন্যান্য অনেক পেশার মানুষ নিয়ে একটি নেটওয়ার্ক। এরা বিজ্ঞান এবং পরাবিজ্ঞানের (যেমন সাইকিক শক্তি) মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে কিনা তা নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা করেন।
১৯৯৫ সালে তিনি রেডিও নিউজিল্যান্ডের বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের একজন ছিলেন এবং এখানে সাত বছর কাজ করেছেন। তবে পরবর্তীতে সংবাদ ও বিভিন্ন ঘটনা বিষয়ে রেডিও নিউজিল্যান্ডের পক্ষপাতদুষ্টতা নিয়ে এক রিপোর্ট লিখেছিলেন।
‘আর্টস এ্যান্ড লেটার্স ডেইলি’ (http://www.aldaily.com/ ) নামে একটা ওয়েবসাইট শুরু করেছিলেন ১৯৯৮ সালে। অনেকেই বলেন এটি তাঁর সবচেয়ে প্রভাবশালী অর্জন। তাঁর মৃত্যুর পর ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে তাকেঁ নিয়ে একটি লেখায় এই ওয়েবসাইটের কথা বিস্তারিত ভাবে বলা হয়েছে। আগ্রহীরা লেখাটি অনলাইনে পড়তে পারেন এখান থেকে: http://online.wsj.com/article/SB10001424052748704405704576064540563199586.html?KEYWORDS=denis+dutton। এই ওয়েবসাইটে প্রতিদিন তিন/চারটা লিঙ্ক পোস্ট করা হয় সাহিত্য ও শিল্প বিষয়ক বিভিন্ন লেখার যা সারা পৃথিবীর অনলাইন লেখা থেকে সংগৃহীত। বর্তমানে প্রতিমাসে এই সাইট ভিজিট করেন তিন মিলিয়নেরও বেশী পাঠক। এই ওয়েবসাইটের তিন মাস বয়সেই লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা বলেছিল এটা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ওয়েবসাইট। ১৯৯৯ সালে ক্রনিকল অফ হাইয়ার এডুকেশনের কাছে $২৫০,০০০ দামে ওয়েবসাইটটি বিক্রি করেন তিনি।
২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে Bloomsbury Press থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর বই ‘The Art Instinct – Beauty, Pleasure & Human Evolution’। এই বই সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য ও রিভিউ পাওয়া যাবে এখানে: http://theartinstinct.com/। আমার অনুবাদটিও এই বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে তাঁর দশ মিনিটের বক্তৃতার থেকে নেয়া। এছাড়াও এই বই বিষয়ে Google একটি এক ঘণ্টার সেমিনার করেছিল, সেটা দেখা যাবে এখান থেকে: http://www.youtube.com/watch?v=R-Di86RqDL4
২০১০ সালের ১৫ ডিসেম্বর তাঁকে কেন্টারবেরি ইউনিভার্সিটি রিসার্চ পদকে সম্মানিত করা হয়। এ সময়েও তাঁর শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল না। হুইল চেয়ারে করে অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। এর দুই সপ্তাহের মধ্যেই ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ, ২০১০ সালে প্রোস্টেট ক্যানসারে মারা যান ডেনিস ডাটন।





হারুকি মুরাকামির গল্প উড়োজাহাজ

সেই বিকেলে মেয়েটি তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “যে ভাবে তুমি নিজের সঙ্গে কথা বলো, তা কি পুরনো অভ্যাস?” টেবিলের ওপর থেকে চোখ তুলে সে এমনভাবে প্রশ্নটা করল যেন ওই ভাবনা তাকে এই মাত্র আঘাত করেছে। বলাই বাহুল্য আসলে তা করেনি।
রান্নাঘরের টেবিলে মুখোমুখি বসেছিল দুজন। পাশের রেলসড়ক দিয়ে কম্পিউটার ট্রেনের যাতায়াতের শব্দ ছাড়া ওই এলাকাটা বেশ নীরব। ট্রেনবিহীন রেলসড়কটা তাদের জন্য এক রহস্যময় নৈঃশব্দ তৈরি করে। কিচেনের পাতলা প্লাস্টিকের মেঝে ছেলেটার পা দুটোকে শীতল পরশ দান করে। মোজা খুলে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে সে। এপ্রিল মাসের বিকেল হলেও আজকের আবহাওয়ায় একটু বেশি গরমের ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। মেয়েটা তার বিবর্ণ চেক সার্টের হাতা কনুই অবধি গুটিয়ে রেখেছে। তার পলকা ফরসা আঙুলগুলো খেলছে কফি চামচের হাতলের সাথে। ছেলেটা তার আঙুলগুলোর দিকে তাকায়, আর তার মনের ক্রিয়া অদ্ভুতরকমের নীরস হয়ে পড়ে।
ছেলেটা কেবল কুড়িতে পড়েছে, মেয়েটা তার চেয়ে সাত বছরের বড়, বিবাহিত ও এক সন্তানের জননী। ছেলেটির জন্য মেয়েটি হচ্ছে চাঁদের দূরের অংশ।
তার স্বামী এমন একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ যারা বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থা করতে পারদর্শী। ফলে তাকে মাসের অধিকটা সময় দেশের বাইরের কোনো শহর যেমন লন্ডন, রোম কিংবা সিঙ্গাপুরে থাকতে হয়। অপেরা ওই ভদ্রলোকের খুব প্রিয়। তার শেলভে তাই জায়গা করে আছে ভার্দি, পুসিনি, দোনিজেত্তি বা রিচার্ড স্ট্রাউসের রেকর্ড। যখন ফুরিয়ে যায় কিংবা করবার কিছু থাকে না ছেলেটা রেকর্ডের শেলভের এ পাশ থেকে ও পাশে চোখ বুলায় আর মনে-মনে অ্যালবামগুলোর নাম পড়ে — লা বোহ…মি, টোসকা, টুরানডট, নরমা, ফাইডেলিও… সে কখনো এসব মিউজিক শোনেনি বা শোনার সুযোগ তার হয়নি। তার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিতদের কেউই অপেরার ভক্ত নয়। শুধু জানে অপেরা-সঙ্গীতের অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে আছে, কিছু লোক তা শোনে; তবে মেয়েটির স্বামীর এই রেকর্ডগুলো দেখে সে ওই জগৎ সম্পর্কে প্রথম জ্ঞান লাভ করেছে।
মেয়েটিও অবশ্য অপেরার ভক্ত নয়। “তবে ওগুলো আমি ঘেন্না টেন্না করি না। ওগুলোর একটাই দোষ, বড় দীর্ঘ।” বলে সে।
রেকর্ডেও শেলভের পাশেই চমৎকার একটা স্টিরিও সেট। এটার উপস্থিতি সত্যিকার অর্থেই ব্যতিক্রমধর্মী। তবে বাজানোর সময় ওটা সে দেখেনি কখনো। মেয়েটিও জানে না ওটার পাওয়ার সুইচ কোথায় আর ছেলেটি ওটি স্পর্শ করার কথাও ভাবেনি কখনো।
মেয়েটি ওকে বলেছে “ঘরে কোনো সমস্যা নেই আমার। স্বামী আমার কাছে খুবই ভাল। মেয়েকে আমি স্নেহ করি খুব। আমি মনে করি আমি সুখী।” তাকে বেশ শান্তশিষ্টই মনে হয়। তার কথা থেকে আঁচ করা যায় না যে, সে তার জীবনের ব্যাপারে অজুহাত দাঁড় করাচ্ছে। নিষ্ঠার সঙ্গে সে তার বিয়ের কথা বলে, যেন সে ট্রাফিক আইন কিংবা আন্তর্জাতিক ডেটলাইন নিয়ে আলোচনা করছে। “আমার ধারণা আমি সুখী, কোনো ঝামেলা নেই।” এই হচ্ছে তার বক্তব্য।
সে তখন অবাক হয়ে ভাবে, তাই যদি হয় তাহলে তুমি কেন আমার সঙ্গে বিছানায় যাচ্ছ ? এ নিয়ে অনেক ভেবেছে ছেলেটি; কিন্তু কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। কথাটা তাকে জিজ্ঞেস করার কথাও ভেবেছে সে। কীভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারেনি। বলেই বা কেমন করে ? “এতই যখন সুখে আছ তাহলে আমার সঙ্গে শুতে আস কেন” একথা কী করে জিজ্ঞেস করে। সে জানে এ প্রশ্নের মুখোমুখি হলে নির্ঘাৎ কেঁদে ফেলবে ও।
হামেশাই বিস্তর কাঁদে সে, অনেকক্ষণ ধরে, খুব কম শব্দ করে। ছেলেটি বলতে গেলে জানেই না কেন সে কাঁদে। এক বার শুরু করলে থামতেই চায় না। সে অবশ্য তাকে সান্ত¦না দেয়ার চেষ্টা করে; কিন্তু নির্দিষ্ট একটা সময় পার না-হওয়া পর্যন্ত কান্না থামায় না সে। কেন মানুষ একে অন্য থেকে এত আলাদা? অবাক হয়ে ছেলেটি ভাবে। অনেক মেয়ের সঙ্গে মিশেছে সে। সবাই কেঁদেছে অথবা রাগ করেছে, তবে সবারই একটা বিশেষ ভঙ্গিমা ছিল। মিলও ছিল বিস্তর, সেগুলো অমিলের তুলনায় অনেক কম। ওখানে অবশ্য বয়সের কোনো তারতম্য ছিল না। বয়স্ক কোনো নারীর সঙ্গে এই তার প্রথম; কিন্তু বয়সের পার্থক্য ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি সে। বয়সের পার্থক্যের চেয়ে বেশি অর্থবহ ছিল প্রতিটি রমণীর নানা ঝোঁক বা প্রবণতা। সে না ভেবে পারেনি। জীবনের রহস্য খোলার জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ চাবি।
কান্না শেষ হলে সাধারণত তারা রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। কান্নার পরে মেয়েটিই সব সময় উদ্যোগটা প্রথমে নেয়, অন্য সময় ছেলেটি এগিয়ে আসে। কখনো মেয়েটি কোনো কথা না বলে শুধু মাথা ঝাকিয়ে প্রত্যাক্ষান করে। তখন তার চোখ দুটো সকালের আকাশে ভাসমান সাদা চাঁদের মতো দেখায়। সে যখন ওই চোখের দিকে তাকায় তার মনে হয়, তাকে আর কিছু বলা মোটেও সম্ভব নয়। রাগ কিংবা অসন্তোষ কোনোটাই আসে না। এভাবে হয়ে যায় সবকিছু, ভাবে সে। কখনো-কখনো খুব স্বস্তি অনুভব করে। ধীরে ধীরে গল্প করতে করতে কফি পান করে। অধিকাংশ সময়ই তাদের কথাবার্তা থাকে অসম্পূর্ণ। দুজনের একজনও বাকপটু নয়, তবে কিছু কিছু ব্যাপারে তাদের অভিন্ন বক্তব্য থাকে।
তাদের যৌন মিলন ঘটে খুবই স্তব্ধতার ভেতর। একে কোনো ভাবেই শরীরী আনন্দ বলে অভিহিত করা যায় না। তবে একথা বললে ভুল হবে যে, ওই মিলনে যে-সুখানুভূতি সে সম্পর্কে অবহিত নয় তারা। দেহ-মিলনের মধ্যমে ছেলেটি যে-আনন্দ লাভ করে আগে সে তা পায়নি কখনো। ওটা তাকে ছোট্ট একটা সুন্দর পরিচ্ছন্ন ঘরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যা একটা আরামদায়ক স্থান।… পরিস্থিতির এই অদ্ভুত অবস্থাটা তার জন্য একটু বেশিই। তার বিশ্বাস নিজের বিচার বিবেচনা দিয়েই জীবনের পথ চলছে সে। কিন্তু যখন সে এই ঘরে বসে আছে, ট্রেন চলে যাওয়ার শব্দ শুনছে আর নিজের বাহুতে আকড়ে ধরে আছে তারচেয়ে বেশি বয়সের এক মহিলাকে তখন সে বিভ্রান্তি অনুভব না করে পারে না। বার বার নিজেকে প্রশ্ন করে, আমি কি তার প্রেমে পড়েছি? কিন্তু পুরো দৃঢ়তা নিয়ে কোনো কোনো সদুত্তর খুঁজে পায় না।
শরীরের খেলা শেষ হলে মেয়েটি ঘড়ির দিকে তাকায়। ছেলেটির বাহুর ওপর শুয়ে মুখখানি একটু ওঠায় এবং ঘড়িঅলা রেডিওটার দিকে দৃষ্টি দেয়। তখন বাইরের রেলসড়ক দিয়ে একটা ট্রেন দ্রুত চলে যায়। কন্ডিশন্ড রিফ্লেক্সের মতো: সে তাকায়, একটা ট্রেন চলে যায়।
মেয়েটি বার বার ঘড়ি দেখে নিশ্চিত হয় তার মেয়ের স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়নি। একবারই মাত্র ছেলেটি তার বাচ্চাটার দিকে তাকিয়েছিল। তার কাছে মনে হয়েছে মেয়েটি ফুটফুটে সুন্দর। সে ওর অপেরা-প্রেমী স্বামীকে কোনো দিন দেখেনি, ভাগ্যক্রমে যে একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করে।
মে মাসের এক বিকেলে সে প্রথম নিজের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারটি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করেছিল। সেদিনও কেঁদেছিল মেয়েটি তারপর সঙ্গমে রত হয়েছিল। কেন সে কেঁদেছিল মনে নেই ওর। তার মাঝে-মাঝে মনে হয় কারও বাহুবন্ধনে কাঁদতে পারবে বলেই সে ওর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছে। হতে পারে সে একা কাঁদতে পারে না, সেজন্য ওকে বেছে নিয়েছে।
সেদিন সে দরজায় তালা লাগাল, পর্দা নামাল, টেলিফোন সেটটি বিছানার পাশে এনে রাখল তারপর মিলিত হলো; আগের মতোই ধীরেসুস্থে, নীরবে। তখন ডোরবেল বাজল। উপেক্ষা করল সে। চমকালো না, অবাকও হলো না। শুধু মাথা নাড়াল একটুখানি, যেন বলতে চাইল, “ও কিছু না ঘাবড়াবার কিছু নেই।” বেল বাজল আরও কয়েক বার। যে-ই বাজাচ্ছিল না কেন, ক্ষান্ত দিয়ে চলে গেল। কোনো সেলস্্ম্যানট্যান হতে পারে। কিন্তু সে কী করে এত নিশ্চিন্ত থাকছে? একটু আগে একটা ট্রেন চলে গেল গুড় গুড় করে। দূর থেকে ভেসে এলো পিয়ানোর সুর। খুব অস্পষ্টভাবে সুরটা আঁচ করতে পারল ছেলেটি। অনেক দিন আগে সঙ্গীতের ক্লাসে সুরটি শুনেছিল সে, কিন্তু ঠিক ঠিক মনে করতে পারল না। সবজি বোঝাই একটা ট্রাক ঠন ঠন শব্দ তুলছিল। চোখ বন্ধ করে মেয়েটি গভীর শ্বাস টানল, প্রশান্তি নেমে এলো ছেলেটির মধ্যে।
সে বাথরুমে ঢুকল গোসল করতে। ফিরে এসে টাওয়েলে মাথা মুছতে-মুছতে লক্ষ করল বিছানায় মুখ ডুবিয়ে শুয়ে আছে সে। তার পাশে বসে ওর পশ্চাৎ দেশ ডলাই মলাই করতে করতে অপেরা-রেকর্ডগুলোর নাম পড়তে লাগল।
মেয়েটি উঠে কাপড়-চোপর ঠিক করল, তারপর কফি বানাতে রান্নাঘরে ঢুকল। তার কিছুক্ষণ পরে সে জিজ্ঞেস করল, “নিজের সঙ্গে ও রকম কথা বলাটা কি তোমার পুরনো অভ্যাস?”
“ও-রকম? তার মানে তুমি কি বলতে চাইছো ওটা করার সময়…?”
“না না, সে সময় না, যে-কোনো সময়। এই ধরো যখন গোছল করছ কিংবা আমি যখন কিচেনে, তুমি একা বসে খবরের কাগজ পড়ছ, ওই রকম আর কী…”
মাথা নাড়িয়ে সে বলল, “জানি না, কখনো খেয়াল করিনি। নিজের সঙ্গে কথা বলি আমি?”
ছেলেটির লাইটারটা নিয়ে খেলতে-খেলতে সে বলল, “সত্যি তুমি নিজের সঙ্গে কথা বল।”
“তোমার কথা অবিশ্বাস করছি না।” বলল সে। এ কথার অস্বস্তি তার কণ্ঠস্বরে ধরা পড়ল। তার হাত থেকে লাইটারটা নিয়ে একটা সিগারেট ধরাল সে। অল্প কিছু দিন আগে সেভেন স্টার ব্র্যান্ডের সিগারেট খেতে শুরু করেছে সে, ওর স্বামীর ব্র্যান্ড। আগে তার ব্র্যান্ড ছিল হোপ। তার কথায় সে ব্র্যান্ড বদলায়নি, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সে নিজেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে। এতে সহজ হবে সব কিছু, টিভির ওই মেলোড্রামার মতো…।
“শোন, আমিও নিজের সঙ্গে কথা বলতাম,” বলল সে, “তবে যখন ছোট ছিলাম।”
“ও, তাই নাকি?”
“মা আমার ওই অভ্যাসটা গাঢ় হতে দেননি। প্রায়ই তিনি বলতেন, বাচ্চা মেয়েদের নিজের সঙ্গে কথা বলতে নেই।” যখনই আমি কাজটা করতাম ভীষণ ক্ষেপে যেতেন তিনি। একবার তো একটা বড় বাক্সের ভেতর ঢুকিয়ে রেখেছিলেন আমাকে। জায়গাটা ছিল অন্ধকার, দুর্গন্ধে ভরা, এমন বাজে জায়গার কথা ভাবাই যায় না। মাঝে মাঝে রুলার দিয়ে আমার হাঁটুর ওপর বারিও মারতেন। কাজ হয়েছিল তাতে। নিজের সঙ্গে কথা বলার রোগটি সারতে বেশি সময় লাগেনি।”
কোনো কিছু বলার কথা ভাবতে পারেনি সে, বলেও নি। মেয়েটি শুধু ঠোঁট কামড়িয়েছিল।
“এখনও যদি কোনো কিছু একটা বলতে চাই আপন মনে, বাক্যটা বেরুনোর আগেই গ্রাস করে ফেলি। কিন্তু নিজের সঙ্গে কথা বলা এত খারাপ কেন, বুঝি না আমি। মুখ থেকে বেরুনো স্বাভাবিক বচন বই তো নয়! মা জীবিত থাকলে জিজ্ঞেস করতাম তাকে।”
একটা কফির চামচ নাড়ানাড়া করছিল মেয়েটি। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকাল। ঠিক সেই সময় একটা ট্রেন চলে গেল। তারপর সে বলল, “কখনো-কখনো আমার মনে হয় মানুষের হৃদয় গভীর কূপের মতো, তলায় কী আছে কেউ জানে না। কখনো ক্ষণিকের জন্য তার একটুখানি ওপরে ভেসে উঠলে খানিকটা আঁচ-অনুমান করা যায় সে সম্পর্কে।”
দুজনেই কিছুক্ষণের জন্য সেই কূপের কথা ভাবল।
“নিজের সঙ্গে যখন কথা বলি তখন কী বলি? একটা উদাহরণ দেবে?” ছেলেটি জিজ্ঞেস করল।
কয়েক মিনিট মাথাটা নাড়াল সে, যেন বিচক্ষণতার সাথে ঘাড়ের নড়াচড়া পরীক্ষা করছে। “বেশ শোন তাহলে, ওখানে উড়ো জাহাজের ব্যাপার আছে…”
“উড়োজাহাজ?”
“হ্যাঁ দেখোনি, আকাশে ওড়ে।”
হাসল সে। “এতো কিছু থাকতে উড়োজাহাজ নিয়ে কথা বলতে যাব কেন আমি?”
সে-ও হাসল। তর্জনী ব্যবহার করে আকাশে কল্পিত একটা বস্তু মাপল। এটা তার একটা অভ্যাস।
“তোমার উচ্চারণ কিন্তু খুব স্পষ্ট। তুমি কি নিশ্চিত যে, নিজের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারটা একেবারেই মনে পড়ে না তোমার?”
“একটুও না।”
একটা বলপেন তুলে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড খেলল সে, তারপর আবার ঘড়ির দিকে তাকাল। ঘড়ি তার নিজের কাজ করে যাচ্ছে। পাঁচ মিনিট আগে যখন সে তার দিকে তাকিয়েছিল এখন তার চেয়ে পাঁচ মিনিট এগিয়ে গেছে।
“নিজের সঙ্গে কথা বলার সময় মনে হয় তুমি কবিতা আবৃত্তি করছ।”
একথা বলার সময় মেয়েটির মুখে লালের আভাস ছড়িয়ে পড়ল। তখন এই অস্বাভাবিক ব্যাপারটির সন্ধান পেল সে: আমার নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার ব্যাপারটিতে সে কেন রক্তিম হচ্ছে?
ছন্দ দিয়ে বাক্যগুলো প্রকাশ করতে চাইলে: “নিজের সঙ্গে কথা বলি আমি/ প্রায় যেন/ করছিলাম আবৃত্তি /একটা কবিতা।”
বলপেনটা আবার তুলে নিল মেয়েটি। হলুদ রঙ্গের প্লাস্টিকে তৈরি। কোনো একটা ব্যাংকের দশম বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে বের করা হয়েছে।
কলমটার প্রতি নির্দেশ করে সে বলল, “এর পরে যখন আমি নিজের সঙ্গে কথা বলি, আমি কী বলি তা শুনে-শুনে তুমি লিখে রাখবে। লিখবে তো ?”
সে সরাসরি তার চোখের দিকে তাকাল। “সত্যিই তুমি তা জানতে চাও?”
ছেলেটি সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল।
মেয়েটি এক টুকরো কাগজ তুলে নিয়ে তাতে কী যেন লিখতে লাগল। ধীরে ধীরে লিখলেও কোনো বিরতি নিল না। ছেলেটি চিবুকে হাত রেখে সারাক্ষণ তাকিয়ে রইল ওর চোখের পাতার লোমের দিকে। আর মেয়েটি কয়েক সেকেন্ড পর পর চোখ পিট পিট করতে লাগল। সে যত বেশি ওই চোখের পাতার দিকে তাকিয়ে রইল (কিছুক্ষণ আগেও যা ছিল অশ্রুজলে ভেজা) সে ততবেশি বুঝতে পারল না ওর সাথে বিছানায় যাওয়ার সত্যিকার অর্থ কী। তখন সবকিছু হারানোর একটা অনুভূতি তাকে গ্রাস করে ফেলল। তার মনে হলো সে হয়ত কোনো দিন আর কোথাও যেতে পারবে না। এই ভাবনা তার মধ্যে এমন অতঙ্কের সৃষ্টি করল যে, তা সহ্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়াল তার জন্য। তার অস্তিত্ব আর নিজস্বতা গলে পড়তে যাচ্ছে। হ্যাঁ একথা তো সত্যি: নতুন কাদামাটির মতোন সে তরতাজা আর সে নিজের সঙ্গে কথা বলে, যেন কবিতা আবৃত্তি করে চলেছে…।
লেখা শেষ করে মেয়েটি কাগজটি তার দিকে বাড়িয়ে দিল। ছেলেটি তুলে নিল কাগজখানা।
মেয়েটি বলল, “এর সবটা আমি হৃদয় দিয়ে জেনেছি — যা তুমি বলেছিলে।”
সে জোরে-জোরে পড়ল শব্দগুলো:
উড়োজাহাজ, উড়োজাহাজ, উড়ছি আমি উড়োজাহাজে। উড়োজাহাজ উড়ছে বটে, তবে স্থির, যদিও ওড়ে উড়োজাহাজটাই আকাশ?
সে অবাক। “এই সব আমি বলেছি?”
“হ্যাঁ, একেবারে পুরোটা।”
“অবিশ্বাস্য। নিজেকে আমি এইসব বলেছি আর এর এক বর্ণও মনে নেই আমার?”
ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে মেয়েটি বলল, “তুমি বলোনি তো কে বলেছে আবার। যেমনটা বললাম ওই রকমই ছিল তোমার কথা।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ছেলেটি। “রহস্যজনক একটা ব্যাপার। জীবনে কোনো দিনও উড়োজাহাজের কথা ভাবিনি। এর কোনো স্মৃতিও নেই আমার জীবনে। তাহলে হঠাৎ কেন উড়োজাহাজ চলে আসছে।”
“জানি না। তবে একেবারে ঠিক ঠিক ওই কথা বলছিলে তুমি, ওই যে স্নান করার আগে। তুমি হয়ত উড়োজাহাজের কথা ভাবছিলে না; কিন্তু গহিন কোনো বনের ভেতর অনেক দূরে তোমার মন ভাবছিল তাদের কথা।”
“কে জানে? হতে পারে গভীর কোনো জঙ্গলের ভেতর বসে আমি নিজেই একটা উড়োজাহাজ বানাচ্ছিলাম।”
বলপয়েন্টটা টেবিলে রেখে মেয়েটি তার চোখ তুলল আর ওর দিকে তাকাল।
কিছুক্ষণের জন্য তারা কোনো কথা বলল না। তাদের কাপের কফি মেঘের রঙ ধারণ করে ঠাণ্ডা হয়ে গেল। পৃথিবী তার অক্ষের দিকে ফিরল; সেই সময় চাঁদের ভর ক্রমশ সময় বদলালো। সময় এগিয়ে চলল নীরবে, আর রেললাইন ধরে দ্রুত চলে গেল ট্রেন।
ছেলেটি আর মেয়েটি একই জিনিস নিয়ে ভাবছিল, জিনিসটি আর কিছুই নয়: উড়োজাহাজ, যা ছেলেটির হৃদয় গভীর অরণ্যে বসে তৈরি করছে। কত বড় ওটা, এর আকারই বা কী, কী তার রঙ, কোথায় চলেছে ওই উড়োজাহাজ, তাতে চড়বেই বা কারা?
একটু পরেই মেয়েটি আবার কাঁদতে লাগল। এই প্রথম বারের মতো সে একই দিনে দুবার কাঁদল। এটা একই সাথে শেষবার। এটা ছিল তার জন্য বিশেষ একটা জিনিস। টেবিল উজিয়ে ছেলেটি মেয়েটির কেশ স্পর্শ করল। আশ্চর্যজনক ভাবে ওগুলো তার কাছে একই সঙ্গে শক্ত ও পেলব মনে হলো। আর মনে হলো ওগুলো অনেক দূরে…।

লাইসেন্স টু কিল, অপারেশন মানিকগঞ্জ ::: লিখেছেন-বিদিশা

আমার বিশ্লেষণী ক্ষমতা খুবই কম। কেউ যখন কিছু বলে, কোনো ঘটনার বর্ণনা দেয়, অবলীলায় আমি তা বিশ্বাস করি। কিন্তু একই ঘটনার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা বর্ণনা যখন পাই অন্য একজনের মুখ থেকে, তখন বিভ্রান্ত হই। বুঝতে পারি না, মানুষ বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কেনো বলবে?
গত কয়েকদিন ধরে দারুন এক বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে আমি আছি। মানিকগঞ্জের সেই মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার পর মানুষ যখন শোকের তীব্রতায় হতভম্ব, তখন কয়েকজন মন্ত্রী উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করলেন। রাস্তাঘাটের দায়িত্বে যে মন্ত্রী, তিনি বললেন, এই ঘটনার জন্য রাস্তা কিংবা ট্রাফিক সিস্টেম দায়ী নয়। দায়ী-চালকরা। বিশেষ করে ইঙ্গিত করলেন তিনি বিধ্বস্ত গাড়ির চালকের প্রতি। সে নাকি আর একটি গাড়িকে ওভারটেক করতে যেয়ে এই বিপর্যয় ডেকে এনেছে। মন্ত্রী মহোদয় যে ব্যক্তিকে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, সেই বেচারীর পক্ষে এর প্রতিবাদ করা সম্ভব নয়।
কারণ ইতোমধ্যেই তিনি মৃত, এইসব বাদ-প্রতিবাদের উর্ধে চলে গেছেন। বিষয়টা আমার কাছে বোধগম্য হলো না, ওই হতভাগ্য চালক তো তার প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নয়, তাহলে মন্ত্রী কেনো তাকেই দায়ী করছেন পুরো দুর্ঘটনার জন্য। তাছাড়া তিনি নিজে ওই সময় গাড়িতে কিংবা আশপাশে ছিলেনও না। তাহলে কীভাবে এতো নিশ্চিত হয়ে দায় চাপাতে পারলেন তিনি মৃত চালকের উপর?
কিন্তু ওই যে বললাম, আমার বিশ্লেষণী ক্ষমতা খুবই কম, তার প্রমাণ দিলো এক বন্ধু। বললো সে, কেন তুমি মন্ত্রীর উচ্চারিত বক্তব্যের অন্তর্নিহিত লক্ষ্যটির দিকে তাকাচ্ছ না? তিনি তো মৃত ড্রাইভারের উপর দায় চাপাচ্ছেন না, বরং নিজেকে নিরাপদে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাইছেন। আর একই সঙ্গে অভিযোগের আঙ্গুলটি সরিয়ে দিচ্ছেন পরিবহন শ্রমিকদের নেতা আর এক মন্ত্রীর দিকে!
এইখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো আর একটি চমক। পরিবহন শ্রমিকদের নেতা নিশ্চয়ই দেশের মন্ত্রী হতে পারেন। কিন্তু মন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি কী করে শ্রমিক নেতৃত্বের সেই পদটি ধরে রাখতে পারেন? বাংলাদেশে পরিবহণ শ্রমিকদের সঙ্গে পরিবহণ মালিক কিংবা যাত্রীদের স্বার্থের বিরোধ নতুন কিছু নয়। এই যে আর কদিন পর ঈদ আসছে, তখনই দেখা যাবে পরিবহণ শ্রমিক-মালিকদের দৌরাত্মের বিকট নমুনা। যাত্রীদের সেই ভোগান্তি আর অসহায়ত্বের সময় এই মন্ত্রী যা কিছু বলবেন তা কি কোনো একটি পক্ষের বক্তব্য হয়ে যাবে না? এর মাঝে একটি পত্রিকায় দেখলাম পরিবহণ ফেডারেশনের এই ‘নেতা কাম মন্ত্রী’ নাকি কিছুদিন আগে অনেকটা চাপ দিয়েই কোনোরকম পরীক্ষা ছাড়া ১৮ হাজার ড্রাইভিং লাইসেন্স করিয়ে নিয়েছেন। সেই একই পদ্ধতিতে, অর্থাৎ পরীক্ষায় না বসে আরও ২৫ হাজার অবৈধ ড্রাইভারকে লাইসেন্স দেয়ার জন্য এখন নাকি চাপ অব্যাহত রেখেছেন। খুব শিগগীরই এটা নাকি হয়েও যাবে। যথাযথ যোগ্যতা ছাড়া এই গাড়ি চালানোর লাইসেন্সপ্রাপ্তি, এটা হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার জন্ম দেবে। তবে পাশাপাশি পরিবহণ ফেডারেশনে ওই মন্ত্রীর নেতৃত্বের আসনকে যে অনেকটাই দৃঢ় করবে তা বলা যায় নির্দ্বিধায়।
নিহত ড্রাইভারকে দায়ী করে যোগাযোগ মন্ত্রী’র বক্তব্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। কেবিনেট মিটিংয়েও তিনি বলেছেন ওই কথা, প্রধানমন্ত্রীকে শুনিয়েছেন। পরে অবশ্য গাড়িতে থাকা এক যাত্রী, যিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছেন, জানালেন ওই দিন ওভারটেকিংয়ের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। একই কথা বললেন যে বাসের সঙ্গে ঘটেছে দুর্ঘটনা সেই বাসের ধৃত চালকও। তাহলে, যোগাযোগ মন্ত্রী কেনো আন্দাজে মন্তব্য করলেন? ঘটনার মনগড়া বিবরণ দিলেন প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীদের বৈঠকে? এরকম দায়িত্বপূর্ণ একটি পদে থেকে এতটা বালখিল্য আচরণ কি মানানসই? আমার মনে আরও একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আচ্ছা, আমাদের প্রধানমন্ত্রী কি এখনো যোগাযোগ মন্ত্রীর ওই বক্তব্যই বিশ্বাস করে বসে আছেন? যদি না করে থাকেন, সেটাই বা আমরা বুঝবো কী করে?
আশপাশের বন্ধুদের বক্তব্য থেকে আর একটি বিষয় আমার কাছে স্পষ্ট হলো, যোগাযোগ মন্ত্রীর এই যে আগ বাড়িয়ে ‘আমি কলা খাই না’ জাতীয় বক্তব্য, এর পেছনে আসলে রয়েছে দেশজুড়ে মহাসড়কগুলো যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষন করতে না পারার বিষয়টি। এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ও সম্ভবত এটি। ইতোমধ্যেই কয়েকটি মহাসড়ক যানচলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। এতটাই খারাপ অবস্থা ওগুলোর যে, ওই রুটের বাসগুলো ঘোষণা দিয়ে চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিলো। এই প্রসঙ্গটিও কিন্তু কেবিনেট মিটিংয়ে উঠেছিলো। এবং যোগাযোগ মন্ত্রী যথারীতি দায়টি অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, অর্থমন্ত্রণালয় টাকা পয়সা দিচ্ছে না বলেই নাকি রাস্তা মেরামত করা যায়নি। কিন্তু সমস্যা হলো, এক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী ওই হতভাগ্য ড্রাইভারের মতো মৃত নন। তিনি ঠিকই প্রতিবাদ করলেন। যোগাযোগ মন্ত্রীর অজুহাতকে নাকচ করে দিয়ে বললেন, রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকমতো না হওয়াতেই মহাসড়কগুলোর এই দুরবস্থা।
এই যে দুই মন্ত্রীর দায়িত্ব এড়ানোর ধাক্কাধাক্কি, এটা কিন্তু খোদ প্রধানমন্ত্রীর সামনেই হলো। তিনি দুই মন্ত্রীকেই শান্ত করার চেষ্টা করলেন, এবং পারলেনও একসময়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব কি মন্ত্রীদেরকে শান্ত করা? নাকি জনগণকে শান্ত করা? তিনি কি অর্থ কিংবা যোগাযোগ মন্ত্রীর প্রধানমন্ত্রী, নাকি জনগণের প্রধানমন্ত্রী? মহাসড়কগুলোর এই দুরবস্থা হঠাৎ করে আচমকা একদিনেই তো আর হয়নি, এটা দীর্ঘ অবহেলার চুড়ান্ত একটা রূপ। এই সড়কগুলোর দেখভালের জন্য সরকারের বিশাল একটা বিভাগ রয়েছে। কী করেছেন তারা এতদিন? এর দায়িত্ব কি এড়াতে পারবেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মহোদয়? অন্য অনেক মানুষের মতো আমিও আশা করেছিলাম, যোগাযোগ মন্ত্রীর এই ব্যর্থতাটুকু অন্ততঃ চোখে পড়বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। কিন্তু সেরকম কিছু হয়েছে বলে অবস্থাদৃষ্টে এখনো মনে হচ্ছে না। বরং দু’দিন পর দেখলাম প্রধানমন্ত্রীর ধমক খেয়ে যোগাযোগ মন্ত্রী নিজে গেলেন ভাঙাচোরা মহাসড়ক দেখতে। পত্রিকায় এমনও পড়লাম যে, মন্ত্রীর বিলাসবহুল গাড়িটি ওই খান-খন্দক আর কাদাময় মহাসড়কের কয়েক জায়গায় আটকে গিয়েছিলো। অথচ এই মন্ত্রীই দু’দিন আগে বলেছিলেন রাস্তাগুলো নাকি অতটা খারাপ নয়!
আলোচিত এই মন্ত্রীর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেই। আওয়ামী লীগের সিনিয়র এক মন্ত্রী তো বলেই ফেললেন, ‘মন্ত্রীর চেহারা চকচকে, রাস্তার কেনো বেহাল দশা?’ রাস্তার এই বেহাল দশা দূর করতে তড়িঘড়ি করে অনেক টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আগামী কয়দিন হয়তো বেশ জোড়াতালিও চলবে। কিন্তু সেটা টিকবে কয়দিন, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা যায়। কিন্তু এতকিছুর পরেও সন্দেহ নেই এই মন্ত্রীর টিকে থাকা নিয়ে। হতে পারে প্রধানমন্ত্রী তার অন্য কিছু যোগ্যতায় খুবই খুশি।
আমি জানি না, ছোট মুখে বড় কথা বলে ফেললাম কিনা। তবে গত কয়েকদিনে বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে অনেকের মুখেই এ ধরনের উচ্চারণ শুনেছি। সাধারণ মানুষের এমন প্রতিক্রিয়ার দীর্ঘমেয়াদী কোনো প্রভাব আছে কিনা, তা অভিজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার পর রাজনীতিকরা এসবকে তেমন গুরুত্ব দেন কিনা, বিগত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় এবিষয়ে আমার মধ্যে বিপুল সন্দেহের জন্ম নিয়েছে।
লেখাটি শুরু করেছিলাম তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা দিয়ে। এ বিষয়ে আর একটি তথ্য মাত্র সেদিন জানতে পারলাম। একটি পত্রিকায় পড়লাম, কোনো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে, তাতে একাধিক ব্যক্তি মারা গেলেও, দায়ী চালকের সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড হতে পারে! এমন দুর্বল আইন সবসময়ই ছিলো না। পরিবহণ শ্রমিকরা আন্দোলন করে এটা আদায় করে নিয়েছে। এখন তদন্তে যদি প্রমাণিত হয় ধৃত ওই বাস ড্রাইভারের কারণেই ঘটেছে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, তাহলে তার তিন বছরের বেশি কারাদণ্ড হবে না? এটা তো ‘লাইসেন্স টু কিল!’
এই তথ্যটি আমার জানা ছিলো না। এখন মনে হচ্ছে, অবিশ্বাস্য এই তথ্যটি জানা না থাকলেই বোধ করি কিছুটা কম আতঙ্ক নিয়ে রাস্তায় বের হতে পারতাম। অজ্ঞতা আসলেই অনেক সময় আশীর্বাদ।

লিভ টুগেদার: পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের প্রেক্ষাপট


হুমায়নিকা by প্রসূন বীপ্র (part-1)

 আকাশটা অস্বাভাবিক একটা রুপ ধারন করেছে। স্বাভাবিক ভাবে আকাশ থাকে নীল আর সাদার সংমিশ্রনে । কিন্তু আজ, এখন তার রঙ গাড় ছাই রঙের, প্রায় কালোর কাছাকাছি ।

কালো শুনলেই অনেকটা বিরক্তি লাগে অনেকের । যেমন কোন সুন্দরি বিয়ের পাত্রি কে যদি বলা হয় আপনার যার সাথে বিয়ে ঠিক করা হয়েছে তার গায়ের রঙ কালো। আপনার কি মনে হচ্ছে জানি না, তবে আমার মনে হয় সে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে। তেলে বেগুনে ঠিক কিভাবে জ্বলে ? ব্যাপারটা ঠিক আমার মাথায় ঢোকে না । হওয়া উচিত ছিল তেলে বেগুনে পুড়ে ওঠা । আর না হলে তেলে বেগুনে পুরবে বলে আগুনের মত জ্বলে উঠল। সে যাই হোক, অনেক মেয়ে কাল রঙ কে পছন্দ করে। আমার এক সুন্দরী বান্ধবী মেয়ে-ছেলের সাদা-কালো প্রসঙ্গে আমাকে একদিন বলেছিল, "  দেখ, আমি অনেক সুন্দরি; আমার গায়ের রঙ-ও ফর্সা। এখন আমার জামাই যদি কালো হয় , সে সবসময় আমার মন যুগিয়ে চলতে চাইবে; কারন উলটা  পালটা কিছু করলে পাছে আমাকে হারাবার ভয়। "
মেয়েরা সবসময় চায় তার ছেলেবন্ধুটি তেমন আচরন করুক, যেমনটা প্রভুভক্ত কুকুর তার মুনিবের সাথে করে । কিন্ত তারা এটা যানে না ছেলেরা কুকুর-ই । যতক্ষন ভালবাসা পায় ততক্ষন প্রভুভক্ত কুকুর আর যখন ভালবাসা হারায় তখন পাগলা কুকুর । ছেলেদের কুকুরের সাথে তুলনা করলাম বলে কেউ আবার রাগ করবেন না, সে ব্যাপারে আগে-ভাগেই ক্ষমা চেয়ে রাখছি। যদিও আমি নিযেও ছেলে।
কুকুর তার প্রভুকে ভক্তি করতে থাকুক কিংবা পাগলা হয়ে কামড়াতে থাকুক , আমারা আবার আকাশের দিকে ফিরে তাকাই।
হ্যা আকাশের রঙ আজ কালো, পুরো আকাশ টা যত দূর পর্যন্ত দৃষ্টি যায় , মেঘে ঢাকা। কেমন যেন একটা গুমটো পরিবেশ সৃষ্টি করেছে । আমার মন টাও আজ খুব ... খারাপ নাকি ভালো তা বলতে পারব না। তবে এতটুকু বুঝতেপারছি যে, অনেকটা এখনকার আকাশের মত। তবে আকাশ এখন যা করবে , মন সেটা করবে না। আকাশ মাঝে মাঝে প্রচন্ড শব্দ করবে আর অঝরে বৃষ্টি ঝরাবে । কিন্তু মন সেটা করবে না। সুধু বৃষ্টি ঝরাবে, নিঃশব্দে।
মাঝে মাঝে যখন বিদ্যুৎ চমকাবে , তখন মন ছিনেমায় ফ্ল্যাশব্যাক দেখার মত পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করবে। হঠাত করে যদি বৃষ্টির একটা ঝাপ্টা মুখে এসে লাগে , ফ্ল্যাশব্যাক (স্মৃতি রোমন্থন) শেষ হয়ে যাবে এবং বাস্তবে ফিরে আসবে। আবার বিদ্যুৎ চমকাবে, মন আমার ফ্ল্যাশব্যাক দেখার মত পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করবে । ফ্ল্যাশব্যাক শেষ হবে। এভাবে কয়েকবার ঘটতে থাকবে আকাশ, মেঘ ও বৃষ্টির সম্মিলিত ইচ্ছা অনু্যায়ি । তারপর যখন বৃষ্টি শেষ হবে, তখন পর্দা নেমে যাবে, অর্থাৎ ছিনেমা  শেষ। যাই হোক  ছিনেমা যখন শেষ হয়েই গেল চলুন একসাথে চা-সিগারেট পান করে আসি, যাদের অভ্যেস আছে আর কি। যাদের নেই তারা একটু ব্যাতিক্রমধর্মী ভাব দেখাবার জন্য ছিনেমা শেষে পপকর্ন খেতে পারেন ।
 তবে যাই বলেন, চা আর সিগারেট একসাথে পান করার মজাই আলাদা । চা-সিগারেট খাওয়ার সময় ব্যাতিক্রমধর্মী আড্ডা দেয়ার একটা টপিক খুঁজতে থাকুন, হতে পারে সেটা আজ যে ছিনেমা দেখলাম তার নায়ক । আপনারা খুঁজতে থাকুন, আমি একটু ওয়াশ-রুম থেকে আসছি।
ওয়াশ রুম সম্পর্কে একটা কথা বলি । আমারা বাঙ্গালীরা ওসম্ভব রকম অনুকরনপ্রীয় । অসম্বভব অনুকরন প্রীয় বলাটা ঠিক হল না। বরং বলা উচিত সম্ভব অনুকরনপ্রীয় । কারন ব্যাপারটা সম্ভব বলেই বাস্তবে সেটা ঘটছে । এই যে দেখুন আমরা প্রায়ই বলি ছেলেটা বা মেয়েটা অসম্বভব সুন্দর । কিন্তু এটা ঠিক না । কারন ব্যাপারটা সম্ভব বলেই আমরা সেটা অনুভব করতে পারি ।
সে যাই হোক, প্রথমে আমরা বলতাম পায়খানা, তারপর ইংরেজদের অনুকরনে বলা শুরু করলাম টয়লেট, আর এখন যেটা বলি সেটা আর নাই বললাম ।

উফ এই যে কথা বলতে বলতে প্রেশারটা রিলিজ হয়ে গেছে । মানুষের মল-মুত্র তন্ত্রের (পরিপাক তন্ত্রের নাম জানি, কিন্তু এটাকে ঠিক কি বলে মনে পরছে না) ব্যাপারটাও কেমন যেন অদ্ভুত! হঠাত হঠাত প্রেশার দেয়, আবার একটু চেপে রাখতে পারলে প্রেশারটা রিলিজ হয়ে যায় । একটা ঘটনা মনে পরে গেল ।
আমি তখন অনেক ছোট, বয়ষ ৫ কি ৬ ঠিক মনে নেই। যে বয়ষে ছেলে মেয়েদের নাক দিয়ে শ্রাবনের অঝড় ধারার মত সিকনি ঝড়ে । তাই বলে ভাব্বেন না আমার নাকেও সিকনি ছিল। এ ব্যাপারে আমার মা অনেক সচেতন ছিলেন। যাচ্ছিলাম মায়ের সাথে মামা বাড়িতে। মা বাবার সাথে ঝগড়া করে আমাকে নিয়ে চলেছেন মামার বাড়ি কুমিল্লায়। বাস তার সতন্ত্র গতিতে থেমে থেমে চলছে। কখনো নিওমের বাইরে যোরে চালিয়ে সামনের গাড়িকে ওভারটেক করছে। গাড়ীর ভেতরে বিভিন্ন কিছিমের মানুষ।
পাশের সারির ছিটে বসেছে এক চাচা , যে কিনা তার পাশে বসা অল্প বয়ষী তরুনির দিকে বার বার আড় চোখে তাকাচ্ছে । অল্প বয়ষি তরুনিদের দিকে আড় তাকানোটা আসলে কি? আমি তখন সেটা বুঝতাম না। আপনারা অনেকেই হয়তো ধরে নিয়েছিলেন যে আমি ওই বয়ষেই খুব ট্যাটনা টাইপের ছিলাম। ড্রাইভার সাহেবকে একটা গান ছারতে বললেন একজন যাত্রী। ড্রাইভার সাহেব গানছারলেন "তুমি কি সেই আগের মতই আছো?" কিছুক্ষন গান চলার পরে দেখি মায়ের চ্চোখে জল, প্রথমে বুঝতে পারিনি কেন? পরে অবশ্য জানতে পেরেছি বাবা প্রায়ই মাকে গানটি গেয়ে শোনাতেন। এর মধ্যে হঠাত আমার খুব জোরেসোরে ২ নাম্বারের চাপ আসলো। আনি মাকে তা জানালাম। মা বললেন আর একটু অপেক্ষা কর, আমরা প্রায় পউছে গেছি। আমি
কিছুক্ষন অপেক্ষা করলাম। আবার মাকে বললাম । মা আবার আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন। কিন্তু আমাদের প্রায় পউছোন টা আর পুরপুরিতে রুপ নেই না। এরি মধ্যে আমার মায়ের কাছে পিড়াপিড়ি করাটা চাচার নজর কেড়েছে, তিনি মায়ের কাছে সব শুনে আমাকে বললেন বাবারে পৃথীবি তে সবকিছু আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ি হয় না। আবার এমন অনেক কিছু আছে যা আমাদের মত সাধারন মানুষের ইচ্ছায় হয় না। যেমন এই বাসে ড্রাইভার সাহেব হলেন বিশেষ ব্যাক্তি, কারন উনি একাই ড্রাইভার আর আমরা সবাই প্যাসেঞ্জার। উনি তো একা কারর জন্য বাস থামাবেন না। ধইরয ধরো। পায়খানা পাইলে চাপ দিয়া রাখ, দেখবা একটু পরে আর বেগ দেবে না। চাচা এই কথা বলতে বলতে হঠাত গাড়ির চাক্কা পাংচার হয়ে গেল। যাত্রিরা সবাই চিৎকার চেচামেচি শুরু করল। কিন্তু পরে যখন বুঝতে পারল চেচামেচি করে লাভ নেই সবাই একে একে বাস থেকে নেমে দাড়াল। লাভের লাভ হল আমার, আমি একটু সুযোগ হল ২ নাম্বার করার। মা বললেন এখানে করতে পারবি? আমার একটু লজ্জা লজ্জা লাগছিল। আমি মাকে বললাম আমি পারব না এখানে। আমি চাচার থিউরী অনুসরন করার চেষ্টা করলাম। মা আমাকে কয়েকবার জোর করলেন। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। এর মধ্যে বাসের চাক্কা লাগানো হয়ে গেল। আমাদের বাস হাটি হাটি পা পা বাদ দিয়ে খুব জোরে ইংরেজি হর্সের মত চলা সুরু করল। অনেকটা প্লেনের পাছায় আগুন লেগে রকেটের মত ছুটলো। এরপর আমরা অল্প সময়েই কুমিল্লা পউছে গেলাম। সেই ২ নাম্বার সারলাম গিয়ে নানার বাড়িতে। খানিক চিন্তা করুন সেই কতক্ষন ধরে চেপে রেখেছিলাম। বোধ করি ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন। সেই থেকেই আমি এই গুন্টা অর্জন করেছি, অনেক্ষন চেপে রাখতেপারি। আবার অনেক সময় করছি করছি ভেবে প্রেশার রিলিজ হয়ে যায়।

আসুন আমরা এবার মূল প্রসংগে ফিরে যাই । কথা হচ্ছিল আজকের ছিনেমার নায়ককে নিয়ে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Backstreet Boys - Backstreet Boys - Show Me The Meaning Being Lonely .mp3
Found at bee mp3 search engine
Anupam Roy - Amake Amar Moto Thakte Dao .mp3
Found at bee mp3 search engine

মোট পৃষ্ঠাদর্শন

sironamhin